শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১৩ পূর্বাহ্ন




রাফি হত্যা: যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের মামলায় ফাঁসিয়ে গেলেন এসপি জাহাঙ্গীর সরকার

ফেনী প্রতিনিধি
  • প্রকাশ: শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৯

বহুল আলোচিত ফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় ফেনী থেকে প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারের রোষানলে পড়েছেন ফেনীর সাংবাদিকরা। কর্তব্য কাজে অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ফেনী ছাড়ার আগে তিনি বিভিন্ন থানার ওসিদের ডেকে কয়েক জন সাংবাদিককে মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি সমঝোতা হওয়া মামলায়ও চার্জশিট দিতে বাধ্য করেন। এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের চার্জশিটে নাম অন্তর্ভূক্ত করতে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের এসিআর আটকে রাখেন ফেনীর সাবেক বিতর্কিত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর সরকার। বিভিন্ন সূত্র থেকে এবং নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ওসির ভাষ্যে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

চলতি বছরের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি। ওই দিনই স্থানীয় জনতা অধ্যক্ষকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন। এ ঘটনায় রাফির মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে থানায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা প্রত্যাহার করতে হুমকি-ধমকি দেন অধ্যক্ষের সাঙ্গপাঙ্গরা। একপর্যায়ে ৬ এপ্রিল পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে মাদরাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাত রাফির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করে। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রাফির মৃত্যু হয়।

শুরু থেকেই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করেন সোনাগাজী মডেল থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি (বর্তমানে গ্রেপ্তার) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তার পক্ষে অবস্থান নেন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার। ঘটনাটি নিয়ে যখন দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম সরব, দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নুসরাতের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ এমনকি ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারে নির্দেশ দেন, তখনও ঘটনাস্থলে যাননি এসপি জাহাঙ্গীর সরকার।

মামলায় সিরাজ উদ দৌলাসহ কয়েকজনকে আসামি করতে এসপি-ওসি তালবাহানা করেন বলে নুসরাতের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে। শুধু তাই নয়, পুলিশ সদর দপ্তরেও তিনি (এসপি) ওসির পক্ষে সাফাই গেয়ে চিঠি লিখেন। তাদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তোলে। মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তরের পর ঘটনায় জড়িতরা একে একে গ্রেপ্তার হতে থাকে। বেরিয়ে আসে ঘটনার মূল রহস্য। একপর্যায়ে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে এসপি-ওসিসহ ৪ পুলিশ দোষী সাব্যস্ত হন। ওসি মোয়াজ্জেমকে বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। আর এসপি জাহাঙ্গীর সরকারকে প্রত্যাহার করে সংযুক্ত করা হয় পুলিশ সদর দপ্তরে। অপর দুইজনকেও প্রত্যাহার করে পার্বত্য এলাকায় সংযুক্ত করা হয়।

এদিকে, নুসরাত রাফির জবানবন্দী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া ওসি মো. মোয়াজ্জেমের হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ব্যারিস্টার সুমন। ওই মামলায় কারাগারে রয়েছেন ওসি মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম অবস্থায় এ ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে তার মোবাইল থেকে ফুটেজটি চুরির অভিযোগ এনে সময় টিভির ফেনী ব্যুরোর রিপোর্টার আতিয়ার হাওলাদার সজলের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সজলও পাল্টা ডায়েরি করেন।

জেলা পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসপি জাহাঙ্গীর ফেনী ছাড়ার আগেই কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় তিনি এ ঘটনায় তাকে নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন সাংবাদিককে হেনস্থা করার পরিকল্পনা নেন। তাদের নাম সংবলিত একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ধরিয়ে দেন। বিভিন্ন তদন্তাধীন মামলায় উল্লেখিত সাংবাদিকদের নাম চার্জশীটে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। কয়েকজন ওসি কৌশলে এড়িয়ে গেলেও অন্যদের এসিআরের ভয় দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিলের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন জাহাঙ্গীর সরকার। ১২ মে সন্ধ্যায় তার বদলি আদেশ আসার পর তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশিট তৈরি করান। পরদিন তা দাখিলে বাধ্য করেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসি জানান। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতেও কোর্ট পরিদর্শকসহ অন্যদের নির্দেশ দেন তিনি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় ৩, সোনাগাজী মডেল থানায় ২, দাগনভূঞা থানায় ২ ও ছাগলনাইয়া থানায় ২টি মামলার চার্জশিট আদালতে জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব মামলার অধিকাংশই বাদী পুলিশ। প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা গেছে, জমা দেয়া চার্জশিটে সাংবাদিকদের মধ্যে দৈনিক ফেনীর সময় ও সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনী সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, দৈনিক অধিকার প্রতিনিধি ও অনলাইন পোর্টাল ফেনী রিপোর্ট সম্পাদক এস এম ইউসুফ আলী, বাংলানিউজ স্টাফ রিপোর্টার ও সাপ্তাহিক হকার্স এর বার্তা সম্পাদক সোলায়মান হাজারী ডালিম এবং দৈনিক সময়ের আলো প্রতিনিধি ও দৈনিক স্টারলাইনের স্টাফ রিপোর্টার মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারির নাম রয়েছে।

তদন্তকারী সূত্র জানায়, মামলার এজাহারে এদের কারোর নাম না থাকলেও বাধ্য হয়ে চার্জশীটে তাদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, উল্লেখিতদের নামে ফেনীর কোনো থানায় ইতোপূর্বে সাধারণ ডায়েরিও ছিল না। বিতর্কিত এসপি জাহাঙ্গীর সরকারের রোষানলে পড়ে একসপ্তাহের মধ্যে তারা প্রায় ১০টি মামলার চার্জশিটে আসামি হয়েছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিক ও সচেতন মহলে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।

সাংবাদিক এস এম ইউসুফ আলী জানান, ‘ফেনীতে নানা অপরাধের অন্তরালে পুলিশের শক্তিশালী সিন্ডিকেট’ শিরোনামে ২৩ এপ্রিল দৈনিক অধিকারে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা তাকে মামলায় জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। পরে জানতে পারেন তাকে তদন্তাধীন ৮-১০টি মামলায় চার্জশিটে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

এ ছাড়াও ছাগলনাইয়া কর্মরত দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে দায়েরকৃত মামলা বাদীর সঙ্গে সমঝোতা হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। যুগান্তর ছাগলনাইয়া প্রতিনিধি নুরুজ্জামান সুমন ও অনলাইন পোর্টাল ছাগলনাইয়া ডট কম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির লিটন জানান, প্রতিহিংসাবশত এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকারের নির্দেশে ওসি (তদন্ত) সুদীপ রায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন।

সাংবাদিক নেতৃরা ইতোমধ্যে নবাগত পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি অবহিত করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন, নতুন করে আর কোনো মামলায় সাংবাদিকদের জড়ানো হবে না। এর আগে জমা দেয়া চার্জশিট নিয়ে তার কিছু করার নেই বলেও তিনি জানান।

প্রবীণ সাংবাদিক ও বাসস প্রতিনিধি আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। জেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করার দায়ে তিনি বিতর্কিত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর সরকারের শাস্তি দাবি করেন।

সোনাগাজী প্রেস ক্লাব সভাপতি শেখ আবদুল হান্নান বলেন, নুসরাত রাফি ইস্যুতে শুরু থেকে পুলিশ সুপার ও ওসি বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা ও সাংবাদিকদের সাহসি ভূমিকায় আলোচিত এ ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়। উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাংবাদিকদের হয়রানির তীব্র নিন্দা জানান তিনি।

সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক ফেনী জেলা শাখা সভাপতি অ্যাডভোকেট লক্ষণ বণিক বলেন, যেখানে পুলিশ এ বিভৎস ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে অপচেষ্টা করেছিল সেখানে সাংবাদিকদের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসে। এমনকি পুলিশের তদন্তেও পুলিশ সুপার ও ওসির কর্তব্যে অবহেলা ও বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এরপরও প্রতিহিংসাবশত সাংবাদিকদের তদন্তাধীন মামলায় চার্জশিটে জড়িয়ে হয়রানি করা খুবই ন্যাক্কারজনক ঘটনা। তিনি এসব মামলায় সাংবাদিকদের অব্যাহতির দাবি জানান।

image_pdfimage_print




সংবাদটি ভাল লাগলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই বিভাগের আরো সংবাদ










© All rights reserved © 2019 notunbarta24.com
Developed by notunbarta24.Com
themebazarnotunbar8765