শিমুল শেখ (৮) রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে থাকে। ৩ বছর আগে মা মারা যায়। বাবা জামাল শেখ আর একটা বিয়ে করেছে। ঘরে সৎ মা চোখে দেখতে পারে না। বাবাও সবসময় মারপিট করে। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে । সৎ মায়ের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত দুই বছর আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেনে চলে রাজধানীতে আসে আর কখনো বাড়ি ফিরে যাইনি শিমুল। পরিবারের সাথেও তার আর কখনো কথা হয়নি । রেললাইনে কুলিগিরির বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে সে । কমলাপুর স্টেশনে ঘুমিয়েই দিন-রাত কাটে শিশু শিমুলের। মঙ্গলবার সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হলে শিমুল এসব কথা জানায়।
শুধু শিমুলই নয়, ওর মত আরও হাজার হাজার শিশু পরিবারের অভাব-অনটন, কলহ ও বিভিন্ন সমস্যার কারণে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় দিন-রাত কাটিয়ে দিচ্ছে। যে বয়সে তাদের হাতে বই ও মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার কথা । সে বয়সে এসব শিশুরা জড়িয়ে পরেছে বিভিন্ন চুরি, ছিনতাই এবং নেশা জাতীয় দ্রব্য বিক্রির কাজে। ক্রমেই নিভে আসছে তাদের জীবনের প্রদীপ। অবার অনেকে বিভিন্ন খাবার, ফুল, খেলনা ও বাসের হেলপারি ইত্যাদি করে পার করছে শৈশব। এদের স্থায়ী ঠিকানা গড়ে উঠে বেশিরভাগই ফুটপাথ ও বিভিন্ন স্টেশনে । এসব শিশুরা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমেও শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তির কাজ। জানা গেছে, তাদের দিয়ে ভিক্ষার টাকা তুললেও দিন শেষে কিছুই দেওয়া হয় না তাদের।
স্টেশনে বসেছিল থাকা শিশু জহির (১০)। তার বাড়ি চাদপুর বাসস্ট্যান্ড। সে বলে, ‘ছোট বেলা থেকেই বাবা-মায়ের কোন খোজ-খবর নেই। চাচির কাছে মানুষ হয়েছি। বাবা-মা কোথায় আছে বলতে পারি না। ট্রেনে উঠে এসে নেমেছি কমলাপুর রেলস্টেশনে। তখন বয়স ৫ বছর। ট্রেন থেকে নেমে বসে ছিলাম। ভালো লাগছিলো না। খিদে লাগলে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম কিন্তু টকার অভাবে কিনতে পারতাম না। একটা ট্রেন এলে দেখতাম লোকজন নামত পোলাপান তাদের মাল জিনিসের বোঝা নিত ৩০ টাকা, ৪০ টাকা কইরা দিত। তারপর আমিও এই বোঝা টানা শুরু করি। দিনে ১০০-২০০ টাকা পেতাম। তা দিয়ে আমি অনেক কিছু কিনে খাইতাম। রাতে স্টেশনের ভিতরই ঘুমাই। নেশার জিনিস বিক্রি করি। যখন বাড়ির কথা মনে পড়ে তখন এসব খেয়ে ভুলে থাকি। এখানে এখন ভালো লাগে।
সংসদ ভবন এলাকায় কথা হয় শিশু হাসির (৮) সঙ্গে। বাবা সিদ্দিক ভ্যান চালায়। কিছুদিন আগে মা রজিনা বেগমকে ছেড়ে দেয়। হাসির মা ফুলের মালা বানিয়ে দেয় আর হাসি সেগুলো রাস্তায় ও বিভিন্ন মানুষের কাছে গিয়ে বিক্রি করে। হাসি বলে, আমার টাকা দিয়াই সংসার চালাই। প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা হয়। বাবা আমাদের কোন খবর রাখে না।
কমলাপুর স্টেশনে দেখা হয় রিয়াজের (৮) সাথে। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে সে একবার রাজশাহী, একবার চাদপুর এমন উল্টা-পাল্টা বলে চলেছে। তখন তার এক হাতে পলিথিনে রাখা নেশা জাতীয় ড্যান্ডি ও অপর হাতে সিগারেট খাচ্ছিলো । খেতে খেতে মাটিতে পরে যায় রিয়াজ। এসময় মহানগর ডিএমপির কয়েকজন সদস্য সিভিল পোশাকে আসেন। একজন তাকে হাত ধরে উঠিয়ে বিভিন্ন ভয় দেখান এবং পরবতিতে তাকে ছেড়ে দেয়।
ডিএমপির সদস্যরা জানান, এই শিশুকে আটকিয়ে আমরা কি করবো। পরবতিতে শিশু নির্যতনের দায় নিতে হবে। তাদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা তাদের নাম ও পরিচয় দেননি। শুধু ডিএমপি মাদক নিয়ন্ত্রণ ইউনিট থেকে আসছেন বলে জানিয়েছেন।
পথশিশুদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভ্রাম্যমাণ পথশিশু বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত। এর বড় কারণ তদারকির অভাব। সাধারণত কিশোর বয়সের এসব শিশুরা অপরাধ জগতে প্রবেশ করে অন্য অপরাধীর হাত ধরে। তাতে আবার তারা এক ধরনের আনন্দও পায়। অনেকে আবার ওদের দিয়ে মাদক ব্যবসাও করিয়ে নেয় আজকাল। কারণ প্রশাসন সোচ্চার হওয়াতে ব্যবসায়ীরা শিশুদের বেছে নেয়। এসব পথশিশুর দিকে নজর দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
এসব ব্যাপারে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন মজুমদার ফারুক নতুন বার্তা২৪ ডটকমকে বলেন, ‘এখানে প্রচুর পথশিশু আছে, যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। এদের বাড়ি যেতে বললেও যায় না। বিভিন্ন নেশায় জড়িয়ে পড়ে। আর এসব নেশায় জড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ জমিলা বেগম। জমিলা এই শিশুদের দিয়ে মাদক বিক্রি করায়। পুলিশ জমিলাকে খুঁজছে। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেছি সে নাকি ভারতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শুনেছি জমিলার ছেলে, মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনি সবাই মাদকের সঙ্গে জড়িত। যাকে যেখানে পাওয়া হবে গ্রেপ্তার করা হবে।’
নতুনবার্তা২৪/ইডি