1

সাহাবিদের জীবনের অনন্য ঘটনাবলি

জীবদ্দশায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে যারা চলাফেরা করতেন এবং তাকে অনুসরণ করতেন তাদের বলা হয় সাহাবি। পরিশুদ্ধ সাহাবিদের অসংখ্য কথা মুসলিমদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। কয়েকজন সাহাবির গল্প নিয়ে এ আয়োজন।

আবু হোরায়রা (রা.)-এর মায়ের সম্মান

একদিন হযরত আবু হোরায়রা (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে কাঁদছিলেন। রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে হোরায়রা, তুমি কাঁদছ কেন?’

হোরায়রা বললেন, ‘আমার মা আমাকে মেরেছেন।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘কেন, তুমি কি কোনো বেয়াদবি করেছ?’

হোরায়রা বললেন, ‘না হুজুর কোনো বেয়াদবি করিনি। আপনার দরবার থেকে বাড়ি যেতে আমার রাত হয়ে গিয়েছিল। দেরির কারণ জিজ্ঞাসা করায় আমি আপনার কথা বললাম। আর আপনার কথা শুনে মা রাগে আমাকে মারধর করলেন আর বললেন, হয় আমার বাড়ি ছাড়বি, না হয় মোহাম্মদের দরবার ছাড়বি। আমি বললাম, মা, আপনি বয়স্ক মানুষ। আপনার গায়ে যত শক্তি আছে তত শক্তি দিয়ে মারতে থাকুন। মারতে মারতে আমাকে বাড়ি থেকে করে দিন। তবুও আমি আমার রাসুলকে ছাড়তে পারব না।’

হোরায়রার কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মা তোমাকে বের করে দিয়েছেন আর এজন্য আমার কাছে নালিশ করতে এসেছ? আমার তো এখানে কিছুই করার নেই।’

আবু হোরায়রা বললেন, ‘হে রাসুল, আমি আমার মায়ের বিরুদ্ধে এখানে নালিশ করতে আসিনি।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাহলে কেন এসেছ?’

আবু হোরায়রা বললেন, ‘আমি জানি আপনি আল্লাহর নবী। আপনি যদি হাত উঠিয়ে আমার মায়ের জন্য দোয়া করতেন, যেন আল্লাহ আমার মাকে হেদায়েত করেন।’

তখনই রাসুল (সা.) হাত উঠিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আবু হোরায়রার আম্মাকে হেদায়েত করে দিন।’

রাসুল (সা.) দোয়া করার সঙ্গে সঙ্গেই হোরায়রা বাড়ির দিকে দৌড় দিলেন। পেছন থেকে কয়েকজন লোক আবু হোরায়রার জামা টেনে ধরল এবং বলল, ‘হে হোরায়রা! তুমি দৌড়াচ্ছ কেন?’

হোরায়রা বললেন, ‘তোমরা আমার জামা ছেড়ে দাও। আমি দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে দেখতে চাই আমি আগে পৌঁছলাম নাকি আমার নবীজির দোয়া আগে পৌঁছে গেছে।’

হোরায়রা বাড়িতে পৌঁছে দরজায় ধাক্কা দিলে ভেতর থেকে যখন তার মা দরজা খুললেন তখন হোরায়রা দেখলেন, তার মায়ের সাদা চুল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে। তিনি হোরায়রাকে বললেন, ‘হে আবু হোরায়রা! তোমাকে মারার পর আমি বড় অনুতপ্ত হয়েছি, অনুশোচনা করেছি। আমি বরং লজ্জায় পড়েছি তোমাকে মেরে। হে হোরায়রা! আমি গোসল করেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি রাসুল (সা.)-এর দরবারে নিয়ে চল।’

হোরায়রা তার মাকে রাসুল (সা.)-এর দরবারে নিয়ে গেলেন। তার মা সেখানেই কলেমা পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।

হামেদ আল-লাফাফ (রা.)-এর জুমার দিন

রাসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি ছিলেন হামেদ আল-লাফাফ (রা.)। এক শুক্রবারে জুমার নামাজের আর বেশি সময় বাকি নেই। এই মুহূর্তে বাড়ির পোষ্য গাধাটি অজানা গন্তব্যে উধাও হয়ে গেল। ওদিকে মিলে পড়ে আছে তার একমাত্র খাদ্য আটা। সেটা না আনলে আজ চুলায় আগুনই জ্বলবে না। আবার ফসলের জমিটা পানি শূন্যতায় ফেটে চৌচির। তাতে সেচ দেওয়া আবশ্যক। ত্রিমুখী কাজের চাপ আর অত্যাসন্ন জুমার নামাজ তার মাথায় মিছিল শুরু করল।

তিনি নীরবে কিছুক্ষণ ভাবলেন, এরপর জাগতিক কর্মগুলোর চিন্তা বাদ দিয়ে ছুটলেন মসজিদ পানে। নামাজ শেষ হলো। অফুরন্ত প্রশান্তি নিয়ে তিনি মসজিদ থেকে বের হলেন। এরপর প্রথমেই তিনি ক্ষেতের কাছে গেলেন এবং শুষ্ক জমি পানিতে টইটম্বুর দেখে বিস্ময়ে হতবাক হলেন। জানতে পারলেন, পাশের জমির মালিক নিজের ক্ষেতে পানির লাইন ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ফলে পানি উপচে তার জমিটাতেও সেচের কাজ হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে দেখেন গাধাটি আস্তাবলে সুন্দর করে বাঁধা। ভেতরে প্রবেশ করে দেখন স্ত্রী রুটি তৈরিতে ব্যস্ত। আবার অবাক হওয়ার পালা। শশব্যস্ত হয়ে তিনি স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, ‘কীভাবে কী হলো?’

উত্তরে হামেদ আল-লাফাফের স্ত্রী বললেন, হঠাৎ আমি গেটে কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। গেট খুলে দিতেই গাধাটি বাড়িতে ঢুকে পড়ল। ওদিকে এক প্রতিবেশীর আটা মিলে পড়েছিল, তারটা আনতে গিয়ে ভুলে আমাদের আটা নিয়ে আসে। পরে বুঝতে পেরে আমাদের আটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে।

স্ত্রীর বক্তব্য শুনে হামেদ (রা.) আকাশের দিকে মাথা তুলে মহান প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন। বিড়বিড় করে বললেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার মাত্র একটি কর্ম সমাধা করেছি আর আপনি আমার তিন-তিনটি প্রয়োজন সমাধা করে দিয়েছেন। সত্যি আপনি মহা ক্ষমতাবান দয়ালু।

আবদুল্লাহ ইবনে হুজাইফা (রা.)-এর চুমু

হযরত উমরের (রা.) শাসন চলছে। শুরু হয়েছে রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যুদ্ধে বন্দি হয়েছে অনেক মুসলিম সৈনিক। এদের মধ্যে ছিলেন একজন সাহাবিও। নবীর সাহাবিদের ব্যাপারে উঁচু ধারণা লালন করত রোমানরা। তাই সাহাবি বন্দির কথা শুনে চমকে উঠলেন রোমের সম্রাট। সাহাবির আচরণ, চলাফেরা, কথাবার্তা কেমন হবে এমন নানা প্রশ্ন সম্রাটকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। তাই বন্দিশালা থেকে রোম সিংহাসনে ডেকে পাঠানো হলো সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে হুজাইফাকে (রা.)। হুজাইফাকে দেখে সাদামাটাই মনে হলো সম্রাটের। তবে সাহাবির আত্মিক ছোঁয়ায় মুগ্ধ রোমের শাহি দরবার। হুজাইফার নুরানি ঝলকে সম্রাটের মনে বন্ধনের ঢেউ। আলাপচারিতা শেষে রোমের সম্রাট নিজের মেয়েকেই বিয়ে দিতে চাইলেন হুজাইফার সঙ্গে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি শর্ত আছে। শর্তানুযায়ী, হুজাইফাকে ইসলাম ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এমন প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘একজন নারীর চেয়ে আমার ইমান অনেক দামি।’

কিন্তু নাছোড়বান্দা সম্রাট হুজাইফাকে নিজের অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বললেন, ‘তবু ইমান ছাড়, বিয়ে করো।’

এই প্রস্তাব অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেন হুজাইফা। এবারে ক্ষেপে গেলেন সম্রাট। তিনি নির্দেশ দিলেন, একটি বিশেষ পাত্রে তেল গরম করার জন্য। তিনি এই গরম তেলে হুজাইফাকে পুড়িয়ে মারবেন। তাকে যখন গরম তেলের কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তিনি কাঁদছিলেন। সম্রাট খবর পেলেন, হুজাইফা কাঁদছেন। ভাবলেন, ভয় পেয়েছে। এবার ইমানও ছাড়বে, বিয়েও করবে। সম্রাট হুজাইফাকে বললেন, ‘তুমি কি ইসলাম ছাড়তে প্রস্তুত?’

হুজাইফা বললেন, ‘এটা মনে করবেন না যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি। আমি কাঁদছি এই ভেবে যে, আমার একটি জীবন আর তা এই মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে। যদি আল্লাহ আমাকে দেহের পশম পরিমাণ জীবনদান করতেন আর প্রতিবারই তার সন্তুষ্টির জন্য তেলে জ্বলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারতাম, তাহলে ধন্য হতাম।’

এমন আত্মবিশ্বাস আর ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখে সম্রাট বললেন, ‘যাও নবীর সাহাবি, তোমাকে মুক্ত করে দেব। তবে আমার কপালে চুমু খেতে হবে।’ হুজাইফা বললেন, ‘চুমু খাব। তবে আমাকে একা নয়, সব বন্দিকে মুক্ত করতে হবে।’

সম্রাট রাজি হলেন। সম্রাটের কপালে এক চুমুতে মুক্ত হলেন হাজার বন্দি। মদিনায় ফিরে পুরো ঘটনা তিনি শোনালেন খলিফা হযরত উমরকে। উমর (রা.) মসজিদে নববিতে এই ঘটনা সম্পর্কে ভাষণ দিলেন। উপস্থিত সবাইকে বললেন, তোমরা সবাই আবদুল্লাহ বিন হুজাইফার (রা.)-এর কপালে একটি করে চুমু দেবে। কারণ সে তার মুসলিম ভাইদের জীবন বাঁচিয়েছে। আর আমি নিজেই চুমু দিয়ে শুরু করছি।

গোপন কথায় কেঁদেছিলেন আবু বকর (রা.)

একদিন হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিবি আয়েশাকে (রা.) ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আয়েশা, আজকে আমি অনেক খুশি, তুমি আমার কাছে যা চাইবে তাই দেব। বলো কী চাও?’

চিন্তায় পড়ে গেলেন আয়েশা। হঠাৎ করে তিনি কী এমন চাইবেন, ভুল কিছু চাইলে যদি নবীজি কষ্ট পান? আয়েশা বললেন, ‘আমি কি কারও কাছ থেকে কিছু পরামর্শ নিতে পারি?’ নবীজি বললেন, ‘ঠিক আছে তুমি পরামর্শ নিয়েই আমার কাছে চাও।’

আয়েশা (রা.) হযরত আবু বকর (রা.)-এর কাছে পরামর্শ চাইলেন। আবু বকর (রা.) বললেন, ‘যখন কিছু চাইবেই, তাহলে তুমি মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে মিরাজের রাতে আল্লাহতায়ালার সঙ্গে হয়েছে এমন কোনো গোপন কথা জানতে চাও। আর কথা দাও, নবীজি যা বলবেন তা সর্বপ্রথম আমাকে জানাবে।’

আয়েশা (রা.) নবীজি (সা.)-এর কাছে গিয়ে মিরাজের রাতের কোনো এক গোপন কথা জানতে চাইলেন, যা এখনো কাউকে বলেননি। মুহাম্মদ (সা.) মুচকি হেসে বললেন, ‘বলে দিলে আর গোপন থাকে কী করে! একমাত্র আবু বকরই পারেন এমন বিচক্ষণ প্রশ্ন করতে।’

মুহাম্মদ (সা.) বলতে লাগলেন, ‘হে আয়েশা, আল্লাহ আমাকে মিরাজের রাতে বলেছেন, হে মুহাম্মদ (সা.) তোমার উম্মতের মধ্যে যদি কেউ, কারও ভেঙে যাওয়া মন জোড়া লাগিয়ে দেয় তাহলে আমি তাকে বিনা হিসাবে জান্নাতে পৌঁছে দেব।’

প্রতিশ্রুতি মত, আয়েশা তার বাবা হযরত আবু বকর (রা.)-এর কাছে এসে নবীজির বলে দেওয়া এই কথাগুলো বললেন।

শুনে আবু বকর (রা.) কাঁদতে লাগলেন। আয়েশা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি তো কত ভেঙে যাওয়া মন জোড়া লাগিয়েছেন, আপনার তো সোজা জান্নাতে যাওয়ার কথা। তবে কাঁদছেন কেন?’

আবু বকর (রা.) বললেন, ‘এই কথাটার উল্টো চিন্তা করে দেখো, কারও ভেঙে যাওয়া মন জোড়া লাগালে যেমন আল্লাহ সোজা জান্নাতে নেবেন, তেমনি কারও মন ভাঙলে যদি সোজা জাহান্নামে দিয়ে দেন! আমি না জানি নিজের অজান্তে কতজনের মন ভেঙেছি।’

হযরত আলী ও কাজি শুরাইহের ন্যায়বিচার

হযরত আলী (রা.) একবার তার প্রিয় বর্মটি হারিয়ে ফেললেন। কিছুদিন পর জনৈক ইহুদির হাতে সেটি দেখেই চিনে ফেললেন। লোকটি কুফার বাজারে বর্মটি বিক্রয় করতে এনেছিলেন। হযরত আলী তাকে বললেন, ‘এ তো আমার বর্ম! আমার একটি উটের পিঠ থেকে এটি পড়ে গিয়েছিল।’

ইহুদি বললেন, ‘আমিরুল মোমেনিন, ওটা আমার বর্ম এবং আমার দখলেই রয়েছে।’ হযরত আলী এবার বললেন, ‘এটি আমারই বর্ম। আমি এটাকে কাউকে দান করিনি, বিক্রয়ও করিনি। এটি তোমার হাতে কীভাবে গেল?’

ইহুদি বললেন, ‘চলুন, কাজির দরবারে যাওয়া যাক।’ হযরত আলী (রা.) বললেন, ‘বেশ, তাই হোক।’

তারা উভয়ে গেলেন কাজী শুরাইহের দরবারে। কাজী শুরাইহ তাদের বক্তব্য জানতে চাইলে উভয়ে বর্মটি নিজের বলে যথারীতি দাবি করেন।

কাজী খলিফাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আমিরুল মোমেনিন! আপনাকে দুজন সাক্ষী উপস্থিত করতে হবে।’

হযরত আলী বললেন, ‘আমার ভৃত্য কিম্বার এবং ছেলে হাসান সাক্ষী আছে।’

শুরাইহ বললেন, ‘আপনার ভৃত্যের সাক্ষ্য নিতে পারি। কিন্তু ছেলের সাক্ষ্য নিতে পারব না। কেননা বাবার জন্য ছেলের সাক্ষ্য শরিয়তের আইনে অচল।’

হযরত আলী বললেন, ‘বলেন কি আপনি? একজন বেহেশতবাসীর সাক্ষ্য চলবে না? আপনি কি শোনেননি, রাসুল (সা.) বলেছেন, হাসান ও হোসেন বেহেশতের যুবকদের নেতা?’

শুরাইহ বললেন, ‘শুনেছি। তবু আমি বাবার জন্য ছেলের সাক্ষ্য গ্রহণ করব না।’

অনন্যোপায় হযরত আলী ইহুদিকে বললেন, ‘ঠিক আছে। বর্মটা তুমিই নিয়ে নাও। আমার কাছে এই দুজন ছাড়া আর কোনো সাক্ষী নেই।’

ইহুদি তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘আমি স্বয়ং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ওটা আপনারই বর্ম। কী আশ্চর্য! মুসলমানদের খলিফা আমাকে কাজির দরবারে হাজির করে আর সেই কাজি খলিফার বিরুদ্ধেই রায় দেন। এমন সত্য ও ন্যায়ের ব্যবস্থা যে ধর্মে রয়েছে আমি সেই ইসলামকে গ্রহণ করেছি। আর সিফফিন যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমি খলিফার পিছু পিছু যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তার উটের পিঠ থেকে এই বর্মটি পড়ে গেলে আমি তা তুলে নিই।’ এবার আলী (রা.) বললেন, ‘বেশ! তুমি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছ, তখন আমি ওটা তোমাকে উপহার দিলাম।’

এই ঘটনার কিছুকাল পর ইহুদি লোকটি হযরত আলীর নেতৃত্বে খারেজিদের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন।

সদ্য বিবাহিত সাদ (রা)-এর শাহাদাতবরণ

সাদ আল আসওয়াদ আস-সুলুমি (রা.) ছিলেন গরিব, গায়ের রং কালো। কেউ তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চাইত না। সাদ (রা.) একদিন রাসুল (সা.)-এর কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘হে রাসুলুল্লাহ! আমিও কি জান্নাতে যাব? আমি তো নিচু মাপের ইমানদার হিসেবে বিবেচিত হই। কেউ আমার কাছে নিজের মেয়ে দিতে চায় না।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদকে পাঠালেন ইবন আল-ওয়াহাবের কাছে। ইবন ওয়াহাব ছিলেন মদিনার নেতাদের একজন; সম্প্রতি মুসলমান হয়েছেন। রূপের জন্য বিখ্যাত তার কন্যাও। সেই কন্যা বিয়ে করবে সাদের মতো একজনকে!

স্বাভাবিকভাবেই ইবন ওয়াহাবের প্রতিক্রিয়া ছিল ‘আকাশ-কুসুম কল্পনা ছেড়ে বাড়ি যাও।’ কিন্তু তার কন্যা ততক্ষণে সব শুনে বলে উঠল, ‘বাবা! আল্লাহর রাসুল অনুরোধ করেছেন তাকে বিয়ে করার জন্য, তুমি কীভাবে উনাকে ফিরিয়ে দিতে পার?’ এরপর সাদের দিকে ফিরে বলল, ‘রাসুলুল্লাহকে গিয়ে বলে দিন, আমি আপনাকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তুত।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) ৪০০ দিনার মোহরানায় তাদের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সাদ বললেন, ‘হে রাসুল, আমি তো জীবনে কোনোদিন চারশো দিনার দেখিনি! কীভাবে তা শোধ করব?’ নবীজি সাদকে বললেন, আলী আল-নুমান ইবন আউফ আর উসমান (রা.)-এর কাছ থেকে দুইশো করে মোট চারশো দিনার নিয়ে নিতে। কিন্তু দুজনই সাদকে দুইশোর বেশি করে দিনার দিলেন।

বাড়তি টাকায় বাজারে গিয়ে স্ত্রীর জন্য কিছু উপহার কেনার কথা চিন্তা করলেন সাদ। কিন্তু বাজারে থাকাবস্থায়ই তার কানে এলো জিহাদের ডাক। সাদ যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। স্ত্রীর জন্য উপহার কেনার বদলে কিনলেন একটি তরবারি আর একটি ঘোড়া। এরপর ছুটে গেলেন জিহাদের ময়দানে। নিজের চেহারাটা কাপড় দিয়ে মুড়ে নিলেন, যেন রাসুল (সা.) তাকে চিনে ফেলতে না পারেন। কারণ তাকে দেখলেই তো তিনি বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। সে যে সদ্য বিবাহিত!

যুদ্ধের ময়দানে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন সাদ। এ সময় তার ঘোড়াটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই কালো চামড়া দেখে নবীজি তাকে চিনে ফেলেন। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, ‘হে সাদ, জান্নাত ছাড়া তোমার জন্য আর কোনো আবাস নেই।’ সাদ (রা.) আবারও জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিছু সময় পর সাদ শাহাদাতবরণ করেছেন এমন খবরে রাসুল (সা.) ছুটে গেলেন ময়দানে। সাদের মাথাটি নিজের কোলের ওপর রেখে কাঁদতে শুরু করলেন। কিন্তু একটু পরই তিনি হাসতে শুরু করেন।

আবু লুবাবা (রা.) নামে এক সাহাবি নবীজিকে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ‘হে রাসুলুল্লাহ, আমি আপনাকে এমনটি কখনো করতে দেখিনি।’

আল্লাহর রাসুল বললেন, ‘আমি কাঁদছিলাম কারণ আমার প্রিয় সঙ্গী আজ চলে গেল! কিন্তু এরপর আমি দেখতে পেলাম তার কী ভাগ্য। আল্লাহর কসম, সে এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে হাউদে।’ আবু লুবাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাউদ কী?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এটি এমন এক ঝরনা যা থেকে কেউ একবার পান করলে জীবনে আর কোনোদিন পিপাসার্ত হবে না। এর স্বাদ মধুর চেয়েও মিষ্টি, এর রং দুধের চেয়েও সাদা। আমি তার এইরূপ মর্যাদা দেখে হাসতে শুরু করলাম।’

এরপর নবীজি সাহাবিদের কাছে এসে বললেন, সাদের ঘোড়া আর তরবারি যেন তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে যেন বলা হয়, এগুলো তার বংশধর। নবীজি বললেন, ‘তাকে জানিয়ে দিও আল্লাহতাআলা সাদকে জান্নাতে স্ত্রী দান করেছেন, তারা তার চাইতেও অনেক সুন্দর।’