মহররমের চাঁদ ও কারবালা মিশে আছে মুমিনের অন্তরে। কারবালার স্মৃতি মুমিনকে কাঁদায়। শহীদের রক্ত উজ্জীবিত করেছে ইসলামের শেকড়।
হকের প্রতিনিধির কাছে বাতিলের প্রতিনিধি ‘বায়েত’ (আনুগত্য) দাবি করেছে এমন ঘটনা কোনোকালেই ঘটেনি। বরং ইয়াজিদ মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে ইসলামে কলঙ্কলেপন করেছিল। ইমাম হোসাইন রক্ত দিয়ে তার অমুসলিম কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করেছিলেন।
আর যদি ইমাম হোসাইন ইয়াজিদের হাতে বায়েত নিতেন এবং ইসলামকে ইয়াজিদের হাতে বর্গা দিতেন, তাহলে ইয়াজিদের হাতেই সেদিন ইসলামের মৃত্যু হয়ে যেত। তাই রাব্বুল আলামিন রাসূলের সত্তা ইমাম হোসাইনের কোরবানি গ্রহণ করলেন এবং ইসলামকে জিন্দা করলেন রক্তের বিনিময়ে।
বায়েতের জন্য ইয়াজিদ মদিনায় অনেক ফন্দি এঁটেছিল, ইমাম হোসাইন যখন মদিনা ত্যাগ করলেন, ইয়াজিদ আবার মক্কায় বায়েতের চেষ্টা চালাল; কিন্তু ইমাম হোসাইন মক্কাও ত্যাগ করলেন।
যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টি করা হল যাতে ইমাম হোসাইন বায়েত করে নেন। কিন্তু ইমাম হোসাইন সে পথও পাল্টালেন। কারবালায় কাফেলা থামালে ইমাম হোসাইন বললেন, ‘আমি বায়েত গ্রহণ করব না।’
আশুরার দিন ছিল ইমাম হোসাইনের ‘বিজয়ের’ দিন। কারবালার প্রান্তরে বায়েত করাতে না পেরে পরাজিত ইয়াজিদ তরবারি দিয়ে ইমাম হোসাইনের গলা কেটে ফেলেছে। আর মনে মনে ভেবেছে- মুক্ত হলাম।
কিন্তু ইয়াজিদ জানত না, ইমাম হোসাইন না থাকলেও তার বোন জয়নাব তো থাকবেন। কারবালা যাত্রার প্রস্তুতি থেকে শুরু করে কারবালায় ঘটিত করুণ দৃশ্যের এমন কোনো দিক নেই যা জয়নাব (রা.) পর্যবেক্ষণ করেননি। যুদ্ধের নাজুক দৃশ্য দেখে তার হৃদয়ের শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।
ইমাম হোসাইনের বীরত্বের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল তার সুযোগ্য বোন হজরত জয়নাবের (রা.) হৃদয়ে। হজরত জয়নাব বিশ্ব জননী হজরত মা ফাতেমার (রা.) কোলে বড় হয়েছেন। ইমাম হোসাইনের নিত্য সান্নিধ্য তাকে অমৃত দান করত।
হজরত জয়নাবের বিয়ের প্রস্তাবে তিনি শর্ত দিয়ে বলতেন, প্রতিদিন তাকে ইমাম হোসাইনের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে এবং ইমাম হোসাইন যেখানেই সফর করবেন, তাকেও সেই সফরে যেতে দিতে হবে।
আবদুল্লাহ ইবনে জাফর এ শর্তে রাজি হলে তাদের বিয়ে হয়। তার এ সুদূরপ্রসারী চিন্তাই তাকে কারবালার ঘটনার সুরক্ষক এবং অন্যতম সাক্ষী হিসেবে ইমাম হোসাইনের বিপ্লবকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।
হজরত জয়নাবের দুই সাহসী পুত্র আউন ও মুহম্মদ যুদ্ধে শহীদ হলে ইমাম তাদের তাঁবুতে নিয়ে আসেন। হজরত জয়নাব তাদের বুকের ওপর হাত রেখে বলতে লাগলেন, আমি তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছি।
কারবালার ঘটনায় নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, আরব-অনারব, অভিজাত-গরিব সবারই ভূমিকা রয়েছে। কারবালার শহীদদের মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। কাফেলার নারী-শিশুরা সবাই তৃষ্ণার্ত। পানির জন্য সবাই ছটফট করছিল।
তাঁবু ভারি হয়ে উঠছিল তৃষ্ণার্ত শিশুদের আর্তনাদে। ইসলামের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হজরত আব্বাস (রা.) বিচলিত হয়ে মশক হাতে ঘোড়ায় চড়ে ফোরাতের দিকে ছুটলেন। একাই ফোরাতের তীর দখল করে নিলেন।
তৃষ্ণায় কলিজা ফেটে যাচ্ছে তার; কিন্তু ভাই ইমাম হোসাইনকে পানি পান না করিয়ে নিজে তৃষ্ণা নিবারণ করবেন না। স্বার্থহীনতার এ উদাহরণগুলো স্থান-কালের সীমানা ছাড়িয়ে যায়।
পানির মশক পূর্ণ করে আবার তাঁবুর দিকে ফিরে আসার পথে কুফার এক মুনাফেক খেজুর গাছের পেছন থেকে পতাকাবাহী হজরত আব্বাসকে আঘাত করে। তরবারির আঘাতে তার ডান হাত কাটা পড়ে।
তিনি সেদিকে মোটেই ভ্রুক্ষেপ না করে মশক বাম হাতে আঁকড়ে ধরলেন। এর মধ্যে আরেক মুনাফেক গাছের আড়াল থেকে আঘাত করলে তার বাম হাতও কেটে যায়। এবার তিনি মশক কামড়ে ধরে ইমামের দিকে ছুটলেন।
হঠাৎ কোথা থেকে এক তীর এসে বিধল মশকে। নিমেষেই পানি উত্তপ্ত মরুতে পড়ে গেল। শত্রুরা একের পর এক তরবারির আঘাতে হজরত আব্বাসের দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিল। শক্তি হারিয়ে হজরত আব্বাস ইমামকে সালাম জানিয়ে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়লেন।
আশুরার দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত একে একে ৭১ জন শহীদের লাশ ইমাম হোসাইন (রা.) কাঁধে বয়ে তাঁবুতে নিয়ে এলেন। এরপর নিজে লুটিয়ে পড়লেন যুদ্ধ করতে করতে।
শত্রুরা হজরত জয়নাবসহ রুগ্ণ শিশু, পুত্রহীনা ও বিধবা সর্বমোট ১২ জনকে এক শেকলে বেঁধে শেকলের এক মাথা হজরত জয়নুল আবেদিনের বাহুতে বেঁধে এবং অন্য মাথা হজরত জয়নাবের বাহুতে বেঁধে দেয়।
ইয়াজিদ তাদের তপ্ত মরুতে এখানে-সেখানে, হাটে-বাজারে ঘুরিয়েছে, যাতে দুনিয়াবাসী জানতে পারে ইয়াজিদ বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ যদি ইমাম হোসাইনের পরিবারকে বন্দি না করত, তাদের নিয়ে বিজয় মিছিল না করত, তাহলে হয়তো ইমাম হোসাইনের শাহাদতের বিজয় কারবালার উত্তপ্ত ধুধু ধূলিকণার সঙ্গে উড়ে বেড়াত।
নবী পরিবারকে বন্দি অবস্থায় কুফা থেকে শত শত মাইল দূরে সিরিয়ায় মুয়াবিয়ার সবুজ রাজপ্রাসাদে আনা হল। কিন্তু হজরত জয়নাব এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার পরও ইয়াজিদের দরবারে এমন সাহসী ভূমিকা রাখলেন যে, পুরো দরবার কেঁপে উঠল।
তার ভাষণ শুনে উপস্থিত সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ইয়াজিদও নিশ্চুপ হয়ে গেল। হজরত জয়নাবের তেজস্বী বক্তব্যে সিরিয়ায় বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখে চতুর ইয়াজিদ তার কৌশল বদলাতে বাধ্য হল। বন্দিদের সসম্মানে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করল।
যে ইয়াজিদকে চাটুকাররা জাঁহাপনা বলে ডাকত, সেই ইয়াজিদকে ধমকের সুরে মহীয়সী নারী হজরত জয়নাব বললেন, ‘তোমাদের যে জল্পনা-কল্পনা আর ষড়যন্ত্র আছে- সবই করো।
তবে জেনে রেখো, আমাদের স্মরণকে মানুষের অন্তর থেকে কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না। আমাদের এ বাণী চিরন্তন। আর যারা নিশ্চিহ্ন হবে, সে হবে তুমি ও তোমার চাটুকাররা।’
মদিনার যাত্রাপথে হজরত জয়নাব কাফেলার সহযোগীদের কারবালার দিকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলে তারা তা-ই করল। ২০ সফর বন্দি কাফেলা সেখানে পৌঁছাল।
ইমাম হোসাইনের রওজা জড়িয়ে কান্না ও আর্তনাদে পরিবেশ ভারি হল। প্রতিবছর মহররমের চাঁদ ওঠে। দুনিয়াজুড়ে আহলে বায়েতের অনুসারীরা শহীদানে কারবালার চেতনায় জেগে ওঠে এবং জেগে থাকে।
লেখক-আখতারা মাহবুবা : অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক