মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন




প্রশিক্ষণ কোরিয়ায় আয়েসি ভ্রমণ যুক্তরাষ্ট্রে!

স্টাফ রিপোর্টার
  • প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৯

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির শর্তে ছিল, দক্ষিণ কোরিয়ায় এক মাস প্রশিক্ষণ নেবেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ১৮ প্রকৌশলী। কিন্তু ‘শিক্ষা সফরে’ কোরিয়া ঘুরে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তা, সংসদীয় কমিটির সভাপতির ব্যক্তিগত সচিবসহ ২৬ জন।

এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণে এসব অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, তিন লাখ ৪২ হাজার ডলার ব্যয়ে (প্রায় দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা) শুধু প্রকৌশলীদের দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু বয়সসীমা শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন কিংবা চাকরির মেয়াদ আর দুই মাস বাকি, এমন কর্মকর্তাও দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা সফরে গেছেন। এই ‘শিক্ষা সফরে’ তাদের অর্জিত জ্ঞান কোথায় কাজে লাগবে, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

প্রকল্প পরিচালক কাজী শাহারিয়ার হোসাইন অবশ্য দাবি করছেন, শুধু দক্ষিণ কোরিয়ায় নয়, উন্নত দেশগুলোতেও সফরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে তার এ দাবির পক্ষে কোনো দলিল পাওয়া যায়নি। প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণে সড়ক পরিবহন সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ছয় কর্মকর্তার বিদেশ সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে গিয়েছেন। এ বিষয়ে তার বলার কিছু নেই।

দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা-২ (সাসেক) প্রকল্পের অধীনে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হয়ে রংপুর পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক দুই পাশে পৃথক সার্ভিস লেনসহ চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ৯ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাকি টাকা জোগাচ্ছে সরকার। কোরিয়ান কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনালসহ (কেসিআই) চারটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে প্রকল্পে পরামর্শকের কাজ পেয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে কেসিআইর সঙ্গে ৩৭৯ কোটি টাকার চুক্তি করেছে সওজ। পরামর্শকের প্রস্তাবনায়, তিন লাখ ৪২ হাজার ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রকল্পের প্রকৌশলীদের দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য। প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, এটা শুধু প্রস্তাবনা। কিন্তু সওজের একাধিক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী বলছেন, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছে বলেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। তাই এই প্রস্তাবনা চুক্তিরই অংশ। চুক্তি সংশোধন ছাড়া শর্ত পরিবর্তন করা যায় না।

তিনটি দলে ভাগ হয়ে এই ২৬ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। প্রথম দলে সড়ক পরিবহন সচিব ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম, সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান, প্রকল্প পরিচালক কাজী শাহারিয়ার হোসাইন, অতিরিক্ত প্রধান পরিচালক এনামুল হক, সন্তোষ কুমার রায়, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহবুব আলম খান, উপ-প্রকল্প পরিচালক জয় প্রকাশ চৌধুরী ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমানের নামে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয়।

জিও অনুযায়ী, ১৪ থেকে ২৫ জুলাই তাদের দেশ দুটিতে শিক্ষা সফরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভিসা না পাওয়ায় শুধু দক্ষিণ কোরিয়ায় যায় প্রথম দল। পরে সেপ্টেম্বরে এ দলটি যুক্তরাষ্ট্রে যায়। যদিও জিও অনুযায়ী, এক সফরেই তাদের দুটি দেশে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সড়ক পরিবহন সচিব যুক্তরাষ্ট্রে যাননি। নিজের খরচে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাক্ষাৎ দেননি। প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, সওজ ও কেসিআইয়ের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, নয়জন করে দুটি দলে ভাগ হয়ে ১৮ জন প্রকৌশলী ৩০ দিন করে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা। প্রথম গ্রুপে নির্বাহী থেকে তদূর্ধ্ব প্রকৌশলী এবং পরের গ্রুপে নির্বাহীর কনিষ্ঠ প্রকৌশলীদের থাকার কথা।

কিন্তু সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আবদুর রউফ, মানবেন্দ্র কিশোর মজুমদার এবং অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব সাইদুর রহমানও সড়ক নির্মাণ কৌশল, নকশা ও ইন্টারচেঞ্জের বিষয়ে জ্ঞান নিতে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র যান। তৃতীয় দলের সঙ্গে গত ২২ অক্টোবর দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণে গেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শিরিশ কুমার রায়। প্রকৌশলী না হলেও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতির একান্ত সচিব ইকবাল বিন মতিনও রয়েছেন এ দলে।

তৃতীয় দলে যুক্ত সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান মাসুদ বাপ্পি গত চার মাসে এই নিয়ে তিনবার যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। একই দলে অন্তর্ভুক্ত সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ গোলাম মর্তুজা গত এক বছরে এই নিয়ে পাঁচবার বিদেশ গেছেন। দুই কর্মকর্তা প্রেষণে সাসেক-২ প্রকল্পে রয়েছেন। তারা বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সড়ক পরিবহন বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আবদুর রউফ জানান, তিনি প্রকৌশলী নন। তবে প্রকৌশলীদের এ প্রশিক্ষণে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। তারা কী কী শিখেছেন, তা দেখেছেন। চুক্তিতে শুধু দক্ষিণ কোরিয়ায় এবং প্রকৌশলীদের শিক্ষা সফরের শর্ত রয়েছে কি-না, তা জানা নেই তার। মন্ত্রণালয় থেকে তাকে সফরের জন্য বাছাই করা হয়েছে, তাই তিনি গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কী কী বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তা জানতে চাইলে আবদুর রউফ বলেন, ক্যালিফোর্নিয়াতে এক দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ ছিল। তাতে প্রকৌশলীরা ছিলেন। আরেক যুগ্ম সচিব মানবেন্দ্র কিশোর মজুমদার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘শিক্ষা সফর’ শেষে দেশে ফিরে বর্তমানে ভারতে রয়েছেন প্রশিক্ষণে। তাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত মার্চে প্রধান প্রকৌশলীকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রকল্প পরিচালক কাজী শাহারিয়ার জানান, হাটিকুমরুলে একটি দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করা হবে। ইন্টারচেঞ্জের বাস্তব অবস্থা দেখতে দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন। তবে প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনেক ইন্টারচেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক বলেন, ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে উন্নত। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। নিয়ম মেনেই যুক্তরাষ্ট্র সফর করা হয়েছে।

তবে চুক্তিপত্র বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, প্রকৌশলীরা কোথায় প্রশিক্ষণ নেবেন, তাও এতে নির্ধারণ করা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সওজ প্রকৌশলীরা কোরিয়া ইনস্টিটিউট অব কনস্ট্রাকশন টেকনোলজি এডুকেশনে (কেআইসিটিই) প্রশিক্ষণ নেবেন। তারা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুই ধরনেরই প্রশিক্ষণ নেবেন। যাতে তারা নিজেদের মান উন্নয়ন করতে পারেন এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা তাদের।

বাস্তবে প্রশিক্ষণকে গৌণ করে প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘প্রশিক্ষণার্থীর’ সংখ্যা বাড়াতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ এক মাস থেকে কমিয়ে ১২ দিন করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করা হয়েছে এই সময়ের মধ্যে।

‘প্রশিক্ষণে’ যাওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, তারা দুই দেশের ঐতিহাসিক স্থান দেখেছেন। বাকি সময় দর্শনীয় স্থান দেখেছেন। শপিং করেছেন। তার দেওয়া হিসাবে, দুই সফরে জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের গ্রেড ভেদে ২৬৩ এবং ২৩১ ডলার করে দৈনিক ভাতা দেওয়া হয়েছে। প্রথম দলের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করা উপ-প্রকল্প পরিচালক জয় প্রকাশ চৌধুরী দাবি করেছেন, সরকারের টাকায় নয়- পরামর্শকের খরচে তারা বিদেশ সফর করেন।

কিন্তু প্রকল্প-সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা সমকালকে নিশ্চিত করেছেন, এ দাবি সঠিক নয়। চুক্তি অনুযায়ী, বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ সওজ নিজে ব্যয় করবে। ভাউচার জমা দেওয়ার পর তা পরামর্শক পরিশোধ করবে। পরামর্শককে চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া ৩৭৯ কোটি টাকার মধ্যেই বিদেশে প্রশিক্ষণের খরচ অন্তর্ভুক্ত।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ খুবই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। একই ব্যক্তি বছরে পাঁচ-সাতবার প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও কর্মশালায় অংশ নিতে বিদেশ যান। অনেক কর্মকর্তা এশিয়ার দেশ হলে যেতে চান না। সবাই চান ইউরোপ আর আমেরিকা যেতে।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে অনুমোদন পাওয়া এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক প্রকল্পে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতি তিন দশমিক ৭৫ শতাংশ। জনবল নিয়োগ, পরিসেবা লাইন স্থানান্তর ও ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। সওজের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি বছরে সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে।

image_pdfimage_print




সংবাদটি ভাল লাগলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই বিভাগের আরো সংবাদ










© All rights reserved © 2019 notunbarta24.com
Developed by notunbarta24.Com
themebazarnotunbar8765