1

নারীরা হজব্রত পালন করবেন যেভাবে

হজ হচ্ছে ইসলামের পঞ্চম রোকন। বাইতুল্লায় হজ করার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘এ ঘরের হজ করা হল মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে ব্যক্তির এ ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর সমর্থ আছে।’ (সূরা আলে ইমরান-৯৭)।

রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজব্রত পালন করবে এবং হজের প্রান্তরে স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করবে না এবং এ সম্পর্কিত কোনো গুনাহের কাজে জড়াবে না, সে যেন সেখান থেকে শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরবে। (বোখারি ও মুসলিম)।

হজের বেলায় রাসূল (সা.) যেভাবে তা পালন করেছেন, আমাদের সেভাবেই হজের আমলগুলো পালন করার চেষ্টা করতে হবে।

হারিয়ে গেলে কী করবেন জেনে নিন?
১) হারিয়ে গেলে ভয় পাবেন না। মাথা ঠাণ্ডা রাখবেন। অনেক নারীকে দেখেছি হাউ মাউ করে কান্নাকাটি করতে। এতে কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। আপনি তাড়াতাড়ি ক্লান্ত, আরও ভীত হয়ে পড়বেন। এতে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।

২) আপনার বোরকা এবং সালোয়ার-কামিজে অবশ্যই একাধিক পকেটের ব্যবস্থা রাখবেন। আপনার পাসপোর্টের ফটোকপি, কিছু রিয়েল, মোবাইল সবসময় পকেটে থাকবে। ব্যাগ সব সময় হাতে রাখা কষ্টকর। অনেক সময় ব্যাগ হাতছাড়া হয়ে যায়। টয়লেটে যাওয়ার সময় ব্যাগ নিয়ে যাওয়া খুবই ঝামেলা। তাই পকেটের মধ্যে জরুরি জিনিসগুলো রাখবেন। এতে দলছুট হয়ে পড়লে অসহায় হয়ে পড়বেন না।

৩) সৌদিতে আপনার ঠিকানাটা আরবিতে মুখস্থ করে রাখবেন, যাতে পুলিশ বা ভলেন্টিয়ার পথ দেখিয়ে দিতে পারে। মনে রাখবেন, সৌদি পুলিশ কিন্তু বাংলা বা ইংরেজি বুঝবে না। অবশ্যই ঠিকানাটা মুখস্থ করবেন অথবা আরবিতে লিখে সঙ্গে রাখবেন।

৪) মোবাইল সবসময় সঙ্গে রাখবেন। চার্জারসহ মোবাইলের একটা অতিরিক্ত ব্যাটারি সঙ্গে রাখবেন। মোবাইল চার্জ দেয়ার সুযোগ না থাকলে আপনি যেন অতিরিক্ত ব্যাটারি ভরে জরুরি কথা বলতে পারেন। মোবাইলে কীভাবে ব্যাটারি লাগাতে হয়, দেশে থাকতেই শিখে নিন।

সহজে চিনতে পারবেন এমন একটা সাইনবোর্ডের নিচে দাঁড়িয়ে সঙ্গের কাউকে বা হজ এজেন্সির লোককে ফোন করুন। জেদ্দা এয়ারপোর্টে নেমেই সৌদি সিম সংগ্রহ করে আপনার মোবাইলে ঢুকিয়ে ফেলবেন। দাম বেশি হলেও কিনতে দ্বিধা করবেন না। হোটেলে পৌঁছে মোবাইলের দোকান খুঁজে বের করে সিম কিনতে অনেক সময় লাগে।

এর মধ্যে আপনি যদি হারিয়ে যান, তাহলে যে দুর্ভোগের মুখোমুখি হবেন, তার থেকে খরচ বেশি পড়লেও আগেই সিম সংগ্রহ করে ফেলা ভালো। আপনার মুহরিম এবং হজ এজেন্সির কমপক্ষে দু’জনের নাম্বার মোবাইলে সেভ করবেন। আপনার নাম্বারও তাদের মোবাইলে সেভ করতে বলবেন।

৫) লাখ লাখ হাজীর ভিড়ে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময় হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোথাও যাওয়ার আগেই ঠিক করে রাখবেন হারিয়ে গেলে কোন সময় কোথায় দাঁড়াবেন। যেমন কাবাঘরের একনম্বর গেটের সামনে রাত আটটায় অপেক্ষা করব; অথবা তাওয়াফ যেখান থেকে শুরু করতে হয়, সেই জায়গার সিঁড়ির পাশে মাগরিবের পর দাঁড়িয়ে থাকব। কমপক্ষে দুটি জায়গা ঠিক করবেন। বেশি ভিড় হলে পুলিশ অনেক সময় একটা জায়গাতে দাঁড়াতে নাও দিতে পারে। তখন বিকল্প জায়গাতে থাকবেন। মিনা বা মুজদালিফায় নারী হাম্মামখানার সামনে থাকব, এভাবে আগেই আলোচনা করে নেবেন।

৬) কালো বোরকার ওপর রঙিন ওড়না পরতে পারেন, যাতে দূর থেকে চেনা যায়। ওখানে বেশিরভাগ নারী হাজী কালো হিজাব পরেন বলে কেউ হারিয়ে গেলে দূর থেকে চেনা কঠিন। সহযাত্রী নারীরা সবাই একই রঙের হিজাব এখনই কিনে ফেলুন। হিজাবের পেছনে বাংলাদেশি পতাকা বা বাংলাদেশ নাম লেখা থাকলে দূর থেকে চিনতে পারবেন।

৭) মক্কায় বাংলাদেশ হজ অফিসের ফোন নাম্বার মোবাইলে এখনই সেভ করে রাখুন।

দেশ থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে যান

১) মেয়েদের যে স্বাভাবিক মাসিক অসুস্থতা, সেটা বন্ধ রাখার জন্য ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে আগে থেকেই ওষুধ খাওয়া শুরু করুন। অবশ্যই দেশ থেকে ওষুধ কিনে নেবেন। বাংলাদেশের ওষুধের নাম কিন্তু সৌদি দোকানদাররা বুঝবে না, তখন বিপদে পড়ে যাবেন। তা ছাড়া হজের সময় সব কিছুর দাম বেশি থাকে। দেশে যে ওষুধ সস্তায় পাবেন, সেটা হজের সময় বিদেশি রিয়েল দিয়ে কিনতে গেলে খুব খারাপ লাগে।

২) প্রচণ্ড রোদে যাদের মাথা ধরে তারা অবশ্যই ছাতা ও সানগ্লাসের পাশাপাশি পেইনকিলার সঙ্গে রাখবেন। সৌদি আরবে দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম থাকে। ভিড়ের জন্য মসজিদে ঢুকতে না পারলে রোদের মধ্যে রাস্তায় নামাজ পড়তে হয়। দরকার হলে মাথাব্যথা শুরুর আগেই একটা ট্যাবলেট খেয়ে নেবেন। তবে এটা আবার নিয়মিত করবেন না।

টয়লেটে যাওয়ার সাবধানতা

১) বাংলাদেশের বদনা সৌদির কোনো টয়লেটে পাবেন না। বাংলাদেশের অনেক নারী হাজী ফ্ল্যাশ আর হ্যান্ড শাওয়ার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, জানেন না। তারা টয়লেটে গিয়ে যখন দেখেন পানির কল, বদনা নেই, তখন দিশাহারা হয়ে পড়েন। টয়লেট নোংরা করে নিজেরা নাপাক অবস্থায় বের হয়ে আসেন। এভাবে নিজেরাও পরে নামাজ পড়তে পারেন না আর যেসব হাজীরা সেই টয়লেটে ঢোকেন, তারা বমি করতে করতে বের হন। টয়লেটের নোংরা দৃশ্য বহুদিন পর্যন্ত তাদের তাড়া করে বেড়ায়। দয়া করে হজে যাওয়ার আগে আধুনিক টয়লেটের ব্যবহার সম্পর্কে জেনে নিন। হজ এজেন্সি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। হজ ট্রেনিংয়ের সময় হাজীদের অবশ্যই টয়লেট ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেবেন।

২) প্লাস্টিকের গ্লাভস ফার্মেসিতে পাওয়া যায়, সেগুলো সঙ্গে রাখবেন। অসংখ্য মানুষ যে পাইপ ধরছে, সেটা থেকে রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে। তা ছাড়া হ্যান্ড শাওয়ার অনেকে ময়লা পানিতে ফেলে রাখে। তাই টয়লেটে ঢোকার আগে গ্লাভস পরে নেবেন।

ভিড় এড়িয়ে চলুন

১) মেয়েদের জন্য মসজিদে জামাতে সালাত আদায় ফরজ, ওয়াজিব কিছু না। তাই পর্দা নষ্ট করে পুরুষদের পাশে দাঁড়াবেন না। ভিড় বেশি হলে অপেক্ষা করুন। দরকার হলে পরে একাকী নামাজ পড়বেন।

২) কাবাঘরের একতলায় প্রচণ্ড ভিড় হয়। তই দোতলা বা তিনতলায় চলে যান। ভিড় এড়াতে নামাজের ওয়াক্তের কমপক্ষে দেড় দুই ঘণ্টা আগে মসজিদে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।

৩) হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া, রুকুন এ ইয়ামিন স্পর্শ করা, কাবাঘরের দরজা ধরা, হাতিমে নামাজ পড়া কোনোটাই হজের অপরিহার্য শর্ত নয়। এর কোনো একটিও না করলে আপনার হজ ইনশাআল্লাহ আদায় হয়ে যাবে। তাই পাগলের মতো পুরুষদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি, ধাক্কাধাক্কি করে এ সবের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না।

৪) হোটেলের টয়লেটে ভিড় লেগে থাকতে পারে। হেরেম শরিফে অসংখ্য নারী টয়লেট আছে। ওখানে গিয়ে জেনে নিন কোথায় কোথায় মেয়েদের ওজুখানা, টয়লেট আছে। মেয়েদের হাম্মামখানার শুরুর দিকের টয়লেটে বেশি ভিড় থাকে। আপনারা একটু ভেতরের দিকে বা দোতলা তিনতলা টয়লেটে চলে যাবেন, তাহলে ভিড় কম থাকবে।

বেশি জিনিস সঙ্গে নেবেন না

১) বাংলাদেশিদের তাঁবুতে জায়গা খুব কম থাকে। তাই বেশি বড় সুটকেস নেবেন না। ছোট হাতব্যাগে দরকারি কিছু জিনিস নেবেন। বাড়তি কিছু নিয়ে ঝামেলা বাড়াবেন না।

কেনাকাটা পরে করবেন

১) মক্কা মদিনায় গিয়েই কেনাকাটা শুরু করবেন না, বিশেষ করে সোনার গয়না। কেনার পর ওগুলা কোথায় হেফাজতে রাখবেন, সেটা একটা দুশ্চিন্তা শুরু হয়। হজ শেষ করে তারপর দামি জিনিস কিনবেন। রাস্তায় রাস্তায় দোকান থাকে, তাই পরে কিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

২) সস্তার খেজুর ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হয়। সেগুলো বেশি আগে কিনলে ভেতরে পোকা হয়ে যায়। তাই দেশের জন্য যে খেজুর কিনতে চান, সেগুলো আসার আগের দিন কিনবেন। কোনো কিছুই বেশি কিনে হজের সময় বোঝা বাড়াবেন না।

নফল ইবাদত বেশি করতে গিয়ে মূল হজের যেন কোনো ক্ষতি না হয়

অনেকে সারা রাত জেগে নামাজ পড়েন, উমরাহ তাওয়াফ বেশি বেশি করেন। এভাবে নফল ইবাদত করতে গিয়ে হজের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। খেয়াল রাখবেন আপনি কিন্তু হজের জন্য গেছেন। তাই বেশি বেশি উমরাহ, তাওয়াফ করতে গিয়ে হজের সময় যেন শক্তি শেষ না হয়ে যায়। বয়স্ক অসুস্থ নারী হাজীরা বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করবেন। সব সালাত মসজিদে আদায় করার দরকার নেই। দরকার হলে হজের পরে তাহাজ্জুদ, নফল উমরাহ, তাওয়াফ সামর্থ্য অনুযায়ী করবেন।

মোবাইলের ব্যবহার শিখে নিন

আমাদের দেশের বয়স্ক হাজীদের অনেকেই মোবাইলের ব্যবহার জানেন না। কিন্তু হজের সফরে মোবাইল সঙ্গে রাখা এবং সেটার ব্যবহার করতে পারাটা খুবই জরুরি। দেশে থাকতেই মোবাইল চালানো ভালোভাবে শিখে নিন। মোবাইল চার্জ করা, মোবাইলের ব্যাটারি বদলান, টাকা রিচার্জ করা এ সবকিছু শিখে রাখবেন। মোবাইল ছাড়া কখনই একা কোথাও যাবেন না। দরকার হলে মোবাইলে ফেসবুকে ঢুকে হারিয়ে যাওয়ার খবর দেয়া শিখে রাখুন। কোন জ্ঞান কখন কাজে আসবে বলা যায় না।

একা কোথাও যাবেন না
কাবাঘর বা মসজিদুন নববীর যত কাছেই থাকুন না কেন, ভালো জায়গায় বসার জন্য সবাইকে পেছনে রেখে আগে আগে মসজিদে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। নারী হাজীরা কোনো অবস্থাতেই জামাতে সালাত আদায় করতে গিয়ে দলছুট হওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। সুশৃঙ্খলভাবে দলের সঙ্গে চলাফেরা করবেন।

আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুন, হেফাজতে রাখুন, ভালোয় ভালোয় হজ করে ফিরে আসুন।।