1

ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিয়ে লুকোচুরি: সরকারি হিসাব ২৯ জন, বেসরকারি ৯৩ জন

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গত বুধবার ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে অংশ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘মুগদা হাসপাতালে এসে একটি ভালো চিত্র পেলাম। এখানে ৩৮৭ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এক হাজার ২০০ জনের মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। চিকিৎসকরা ভালো সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে এ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে একজনেরও মৃত্যু হয়নি।’

এ সময় স্থানীয় এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী মঞ্চের চেয়ার থেকে উঠে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হাতে একটি কাগজ দেন। ওই কাগজ দেখে মন্ত্রী বলেন, ‘তারা বলছেন- এ হাসপাতালে ১১ জন মারা গেছে। কিন্তু কতজন ডেঙ্গুর কারণে মারা গেছে, তা নিশ্চিত করতে পারেননি।’

এর আগে ৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, ডেঙ্গু জ্বরে এ পর্যন্ত  ১৪ জন মারা গেছে। তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে সাংবাদিকরা মন্ত্রীর কাছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে ভালোভাবে জেনে পরে জানাতে পারব।’

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছেও নেই। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ৯৩ জন। আবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন মৃতের সংখ্যাও প্রকাশ পাচ্ছে। কোনো কোনো গণমাধ্যম বলছে ১১০ জনের কথা, কোনোটি আবার বলছে ১২০ জনের কথা। এতে করে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছে। প্রশ্ন জাগছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত মৃতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশে বাধা কোথায়?

সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা সংস্থা (আইইডিসিআর) মৃত্যুর হিসাব নিশ্চিত করে থাকে। গত জুলাই মাসে এ লক্ষ্যে আট সদস্যের একটি পর্যালোচনা কমিটিও গঠন করা হয়। সেই কমিটি গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটির এ কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পর্যালোচনার প্রসঙ্গ আসছে কেন :  দীর্ঘ এক যুগ আইইডিসিআরে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান। তিনি একমাত্র বাংলাদেশি রোগতত্ত্ববিদ, যিনি বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে গবেষণার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গঠিত একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটিতে কাজ করেছেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, পর্যালোচনা করে মৃতের সংখ্যা ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা আসছে কেন? মৃত ব্যক্তিদের কি ক্ষতিপূরণ কিংবা বীমা সহায়তা দেওয়া হবে? তা না হলে হাসপাতাল থেকে মৃত ঘোষণার পরও সরকারি হিসাবে কেন সেটি যুক্ত করা হচ্ছে না?

ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, কোনো দেশই মৃত্যুর এ ধরনের পর্যালোচনা করে না। পর্যালোচনা তখনই প্রয়োজন হয়, যখন কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্ন আসে। হাসপাতালে পরীক্ষা করে ডেঙ্গু নিশ্চিত করার পর রোগী মারা গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া এই তথ্যই তো যথেষ্ট। কিন্তু সে ঘোষণা মেনে না নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করা হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে, ডেঙ্গুতে মারা গেছে; আর আইইডিসিআর বলছে, এটি ডেঙ্গু নয়। তাহলে তো মানুষ বিভ্রান্ত হবেই।

সাবেক এই পরিচালক বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরে কেউ স্ট্রোকে মারা গেলেও এই মৃত্যুর হিসাব ডেঙ্গুতেই করতে হবে। আরও কিছু সমস্যা একটি মৃত্যুর প্রভাবক হতে পারে- কিন্তু কেউ কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে সেটিকেই তার মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে গণনা করতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এটিই নিয়ম।

একমত নন আইইডিসিআর পরিচালক :  তবে ডা. মাহমুদুর রহমানের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু পর্যালোচনায় গঠিত আট সদস্যের কমিটির প্রধান ও আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা। তার মতে, একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হয়ে তারা কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেন না।

মৃত্যু পর্যালোচনার প্রক্রিয়া বর্ণনা করে ডা. ফ্লোরা জানান, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনটি ধাপে কাজ করা হয়। হাসপাতাল থেকে তথ্য পাওয়ার পর মৃত ব্যক্তির সমস্ত ক্লিনিক্যাল তথ্য নেওয়া হয়। এরপর মৃত্যুর কারণ জানার জন্য উপসর্গ ও শারীরিক অবস্থার তথ্য বিচার এবং নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তৃতীয় ধাপে ল্যাব পরীক্ষায় দায়ী ভাইরাস পেলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বিষয়টি হিসাব করা হয়। তাই হাসপাতাল থেকে বলা হলেও তারা সঙ্গে সঙ্গে তা ঘোষণা করেন না।

ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মৃত্যু পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়। গত বছর থেকে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। সে সময়ও এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে গত বছর ডেঙ্গুর বিস্তার এত না থাকায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কম হয়েছে।

আক্রান্তের হিসাব নিয়েও প্রশ্ন :  গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩৪ হাজার ৬৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে মৃতের মতো আক্রান্তের সংখ্যা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। কারণ রাজধানীর মাত্র ৪০টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর হিসাব করে এ তালিকা তৈরি করা হয়। অথচ এর বাইরেও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার সরকারি হাপাতালের জরুরি ও বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেওয়া রোগীদের এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর প্রকৃত সংখ্যা এই প্রক্রিয়ায় বের করা সম্ভব হবে না।

মৃতের অপূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান :  চলতি বছরের ২২ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। সে দিন এ রোগে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. শাহাদৎ হোসেন হাজরা মারা যান। একই দিন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান একজন। এর আগে ৬ ও ৭ জুলাই ঢামেক হাসপাতালে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়। ১৯ জুলাই যশোরের একটি হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু আক্রান্তের মৃত্যু ঘটে। এ ছাড়া চলতি বছর সোহরাওয়ার্দী ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে তিনজন, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চারজন, ল্যাবএইড হাসপাতালে একজন, গ্রীন লাইফ হাসপাতালে তিনজন, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে দুইজন, ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন এবং স্কয়ার হাসপাতালে তিন জনের মৃত্যু হয়। সবমিলে ২২ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে ২৭ জনের মৃত্যু হলেও সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ছিল পাঁচ।

এরপর থেকে প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ২ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তঃসত্ত্বা মালিহা মাহফুজা অনন্যা, মিটফোর্ডে আনোয়ার হোসেন, নোয়াখালীতে মোশাররফ হোসেন ও আবদুল মোতালেবের মৃত্যু হয়। ৪ আগস্ট রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহাবুদ্দীন কোরেশীর স্ত্রী সৈয়দা আক্তার, মিটফোর্ডে শেফালী বেগম, ঢাকা শিশু হাসপাতালে আলভী, জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে ইডেন কলেজ ছাত্রী শান্তা ও খুলনার রূপসা উপজেলায় মঞ্জুর শেখের মৃত্যু হয়।

৫ আগস্ট ঢাকা মেডিকেলে হাসান, সোহরাওয়ার্দীতে আবহাওয়াবিদ নাজমুল হকের স্ত্রী শারমিন আক্তার শাপলা, মাদারীপুরের শিবচরে রিপন হাওলাদার, খুলনায় খাদিজা বেগম, রংপুরের মিঠাপুকুরে তৃষা মণি ও ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে অথৈ সাহার মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ সময় ১৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে।

৬ আগস্ট রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ইতালি প্রবাসী হাফসা লিপি, ঢাকা মেডিকেলে মনোয়ারা বেগম, আমজাদ মণ্ডল ও হাবিবুর রহমান, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেলে রবিউল ইসলাম, রংপুর মেডিকেলে রিয়ানা, ঢাকায় মদিনা আক্তার ও মুগদায় আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যু ঘটে। ৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেলে আওলাদ হোসেন, আমেনা বেগম ও আছিয়া বেগম, ঢাকার একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে মিঠুন ফয়সল চৌধুরী ও ইউনাইটেড হাসপাতালে তিতুমীর কলেজের ছাত্র মেহেদী হাসান মারা যান। এভাবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যু ঘোষণা করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, জ্বর নিয়ে হাসপাতালে গেলে প্রথমেই পরীক্ষা করা হয়। ওই পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর তার মৃত্যু হলে সেটিকে তো ডেঙ্গুতে মৃত্যুই বলতে হবে। হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেটি মানছে না। তারা আরও যাচাই-বাছাই করছে। হাসপাতালে ভর্তির পর ল্যাবে পরীক্ষা করেই তো তার শরীরে ডেঙ্গু শনাক্ত করা হয়েছে। তাহলে আবার পর্যালোচনা কেন করতে হবে? কী কারণে তারা এটি করছেন, তা বোধগম্য নয়। এতে করে মৃত্যু নিয়ে তথ্যগত বিভ্রান্তি বাড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, অধিকতর নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা করা দোষের কিছু নয়। এতে হয়তো একটু বেশি সময় লাগছে। তবে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তারপরই তথ্যটি প্রকাশ করা হচ্ছে।