গ্রামের একটি হাটখোলায় রেডিও, টিভি সারতেন আব্দুল হামিদ। হাত যশও ছিল তার। অনেক দুর দুরান্তের গ্রাম গঞ্জ থেকে লোকজন টিভি সারতে আসতো তার কাছে। এলাকার সবাই এক নামেই চিনতেন মেকানিক আব্দুল হামিদ। তার পারদর্শিতার কারণে অনেকেই বলতেন ‘বৈজ্ঞানিক’ আব্দুল হামিদ। টিভি রেডিও মেরামতের পাশাপাশি নতুন কিছু উদ্ভাবনের নেশা ছিল তার প্রথম থেকেই। অনেক সময় রেডিও টিভির বাদ পড়া যন্ত্রাংশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা তৈরী করে গ্রামের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি তিনি সুর্যের আলো আর পানি দিয়ে জ্বালানি গ্যাস তৈরী করে সাড়া ফেলেছেন সারা দেশে। স্থানীয়দের ভাষায় মেকানিক হামিদ যে এমন কান্ড ঘটাবেন তা তারা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। এর আগে তিনি বায়োগ্যাস উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে সাড়া ফেলেছিলেন।
তার প্রতিবেশীরা জানান, এক স্থানে বেশি দিন মন বসতো না হামিদের। এক দু’মাস পর পর স্থান পরিবর্তন করতে হতো। অনেক সময় দোকান ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় খোলা জায়গায় বসে কাজ করতে হয়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের পাল্লার সামঞ্জস্য করতে না পারায় বিরূপ পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হয়েছে আব্দুল হামিদকে। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কাজের প্রতি আলাদা মনোনিবেশ ছিল তাঁর। ছিল অসীম ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা।
আব্দুল হামিদ খুলনার কয়রা উপজেলার কালনা গ্রামের বাসিন্দা মজিবুর রহমানের ছেলে। সংসারে অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশুনাটা বেশি দুর এগিয়ে নিতে পারেননি। পারিবারিক জমি-জমা থেকে যা আসতো সংসারের খরচ জুগিয়ে ভাই বোনের লেখা পড়ার খরচ জোগানো সম্ভব হতো না। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে বাবা, মা আর ৮ ভাই বোনের সংসারের ভার না চাইতেই চলে আসে আব্দুল হামিদের কাঁধে। যে কারনে এসএসসি পাশের পর লেখাপড়া বেশিদুর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি তার। তবে রাত-দিন পরিশ্রম করে অন্য ভাই বোনকে শিক্ষিত করেছেন।
আব্দুল হামিদের দুই বোন এখন শিক্ষকতা করেন। এক বোন স্বামী সন্তান নিয়ে আছেন বিদেশে। মোঝো ভাই রোকনুজ্জামান সরকারি চাকরিজীবি। ছোট ভাই ফজলুল হক গ্রামের বাড়িতে থেকে ব্যবসা করেন। অন্য দুই বোন গৃহিনী। বিয়ে করে সংসার পাতলেও নিজের উদাসীনতার কারনে তা বেশি দিন টেকেনি।
পরিবারে একটু স্বচ্ছলতা ফিরলে আব্দুল হামিদ গ্রাম ছেড়ে চলে যান ঢাকায়। সেখানে একটি সোলার বিদ্যুৎ কোম্পানীতে কাজ নেন। কাজের পাশাপাশি নতুন কিছু উদ্ভাবনের নেশায় পেয়ে বসে তার। নিজের বেতনের টাকায় বিভিন্ন উদ্ভাবন চেষ্টার পাশাপাশি দেশের জ্বালানি সংকটের কথা মাথায় আসে তার। ওই ভাবনা থেকেই একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া। দীর্ঘ ১০ বছরের চেষ্টায় কাঙ্খিত সফলতা আসে। সূর্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পানি থেকে উৎপাদন করেন জ্বালানি গ্যাস। জ্বালিয়েছেন চুলা। তার পরের গল্পটা দেশবাসির জানা।
আব্দুল হামিদের এখন চাওয়া বিকল্প এ জ্বালানির প্রসার হোক সারাদেশে। তার মতে, এর ব্যবহার হলে অন্যান্য গ্যাসের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে না দেশের মানুষকে। সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে তার এ গবেষনাকে আরো সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
আব্দুল হামিদ বলেন, বুঝতে শেখার পর থেকে অভাব অনটনের মধ্যে বড় হয়েছি। মাথায় বিভিন্ন পরিকল্পনা থাকলেও অর্থের অভাবে করা সম্ভব হতো না। তার উপর পরিবারের চাপ ছিল মাথায়। যে কাজটা আরো আগে হওয়ার কথা ছিল সেটি অনেক পরে হলেও দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছি। এটা অনেক আনন্দের।
একটি বেসরকারি টিভিতে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, ‘যেহেতু সূর্যই মূল শক্তির উৎস। সব শক্তি তো আমরা সূর্য থেকে পাই সে কিরণটা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি এটাকে সঞ্চয় করে অন্য শক্তিতে রূপান্তর করি তাহলে ভালো একটা ব্যাপার হবে।’
সেই চিন্তা থেকেই আব্দুল হামিদ সোলার প্যানেল, পানি ও প্লাস্টিকের বোতল, বালতি ও লোহার ব্যারেল জোড়া দিয়ে উদ্ভাবন করেছেন প্রাকৃতিক গ্যাস। ১০ বছরের এ গবেষণায় তার মোট খরচ হয়েছে ৬০ হাজার টাকার মতো। এখনো দিনের বড় একটা সময় তিনি এটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রযুক্তি নিয়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘একটা ল্যাব দরকার যেখানে এটি নিয়ে আরও কাজ করা হবে। আর আর্থিক সহায়তাও প্রয়োজন যাতে গবেষণা এগিয়ে নেয়া যায়।’