1

খুলনায় গডফাদারের আসনে আ’লীগে অনুপ্রবেশকারী সাবেক যুবদল নেতা মুকুল

খুব বেশী দিন আগের কথা নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করে তিনি রাজপথে শ্লোগান দিতেন, যুবদলের ঝটিকা মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন, ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতেন রাজপথে। তাকে গ্রেফতার করায় একবার তার অনুসারীরা পুলিশের গাড়ী ভাঙ্গচুরসহ ব্যাপক অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল। এখন তিনি ভোল পাল্টে আওয়ামীলীগ নেতা। নিজেকে একনিষ্ঠ আওয়ামীলীগ কর্মী দাবি করলেও দলের সাধারণ নেতা কর্মীরা তাকে ‘হাইব্রিড’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে দল থেকে বের করে দেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তাকে নিয়ে খুলনার খানজাহান আলী থানা আওয়ামীলীগের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নতুন গ্রুপিংয়ের। আলোচিত অনুপ্রবেশকারী এই নেতা হলেন, খানজাহান আলী থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও বর্তমান খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের কার্যকরি কমিটির সদস্য মুন্সি মনিরুজ্জামান মুকুল। ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

যুবদল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের তিন বছরেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন তিনি। গড়েছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। আছে বিলাসবহুল গাড়ী ও বাড়ি। সার্বক্ষনিকভাবে রয়েছে হাফ ডজন দেহরক্ষি। দলে যোগদানের পর পরই সবকিছুই যেন যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় পরিবর্তন ঘটে গেছে তার। অবৈধ হুন্ডি ব্যাবসার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাতারাতি এমন অর্থনৈতিক পরিবর্তনে ওই অনুপ্রবেশকারি এই নব্য নেতাকে নিয়ে এলাকায় চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। আওয়ামীলীগের তৃণমূলের ত্যাগী নেতা কর্মীদের বঞ্চিত করে পদ-পদবী পাওয়া ভিন্ন আদর্শের এই কথিত ‘হাইব্রিড’ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি উঠেছে জোরালো ভাবে।

সম্প্রতি তার বিতর্কিত কর্মকান্ড তুলে ধরে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবীতে কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন ২ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি মো. শাকিল আহমেদ  ও সাধারণ সম্পাদক এফএম জাহিদ হাসান জাকির। লিখিত অভিযোগে তারা বলেছেন, মুন্সি মনিরুজ্জামান মুকুল আওয়ামী লীগে যোগদান করলেও বিএনপি নেতাদের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। এর প্রমান স্বরূপ তারা জানিয়েছেন-সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থীকে প্রচার প্রচারণার জন্য ৪০ লাখ টাকা প্রদান করেছিলেন মুকুল। ওই সময়ে সে প্রকাশ্যে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে থাকলেও গোপনে বিএনপি’র হয়ে কাজ করেছেন। নির্বাচনে তিনি নিজ অর্থ ব্যয় করে বিএনপি সমর্থিত একজন কাউন্সিলরের প্রচারনায় সহযোগীতা করেছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর হাতে আটক হন তিনি। তাকে মুক্ত করতে সে সময় তার অনুসারি ছাত্রদল ও যুবদলের নেতা-কর্মীরা রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুর, এমনকি পুলিশের গাড়ীতে হামলা চালায়।

তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে নিজের আখের গোছানোর জন্য এবং নিজেকে শক্তিশালী বাহিনীতে রূপান্তর করার জন্য বেছে নিয়েছেন খুলনা সিটি কর্পোরেশন দুই নম্বর ওয়ার্ডের কিছু প্রতিষ্ঠান। তার  নীলনকশা অনুযায়ী  সোনালি জুট মিলে সিবিএ সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তার চাচা সিরাজ মুন্সীকে। অন্যদিকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে আখ্যায়িত মানিকতলা সি এস ডি গোডাউনে সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন মুকুল মুন্সির নিজের ছোট ভগ্নিপতি মিজানুর রহমান ফিরোজ কে ,যে কিনা ওই প্রতিষ্ঠান কোন শ্রমিক নয়। তিনি কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে মুকুল মুন্সির মাধ্যমে সভাপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। সম্প্রতি ফুলবাড়িগেট এলাকায় কথিত সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ নামে এলাকার বিতর্কিতদের দিয়ে একটি কমিটি করে সন্ত্রাস ও চাদাঁবাজির রাজত্ব কায়েম করেছেন।

খানজাহান আলী থানা আওয়ামীলীগের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি শাকিল আহমেদ বলেন, মুকুল বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানের পর পরই দলে গ্রুপিং করার চেষ্টা করেন। সে চেষ্টায় সফলও হয়েছেন তিনি। বর্তমানে খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগ একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। দলে বিভক্তির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রভাবশালী এক নেতার ছত্রছায়ায় অনুপ্রবেশকারি মুকুল সুকৌশলে তার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত করেছেন। নামে বেনামে গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসায়ি সিন্ডিকেট। গণপূর্ত বিভাগের (পিডাব্লিউডি) টেন্ডারে দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে ও সেখানে চাকুরিরত তার এক মামার সহযোগীতায় সব কাজ একাই বাগিয়ে নিচ্ছেন তিনি। সেখানে অন্য কোন ঠিকাদার সুযোগ পায়না। খুলনার একটি ঘাট দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি গণপূর্ত ও গৃহায়ন মন্ত্রীর খুলনা সফরকালে বিভিন্ন সভা সমাবেশে মুকুলকে মন্ত্রীর পাশে থাকতে দেখা গেছে। তিনি গণপূর্ত বিভাগে চাকরিরত তার মামার সহযোগীতায় মন্ত্রীর ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করছেন বলে স্থানীয় আ’লীগের নেতারা জানিয়েছেন। মন্ত্রীর সাথে সভা সমাবেশে তার উপস্থিতিতে স্থানীয় আ’লীগের সাধারণ নেতা কর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে,  কথিত রয়েছে, গণপূর্তমন্ত্রীর ছোট ভাই শাহিন তার ব্যাবসায়িক পার্টনার।

স্থানীয় আ’লীগ নেতা সরদার জাহিদ হাসান বলেন, মুন্সি মনিরুজ্জামান মুকুলের পিতা মুন্সি জহুরুল হক স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারদের হয়ে কাজ করেছে। এলাকায় তিনি বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। মুকুল আ’লীগে যোগদান করলেও তার অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে সব কর্মচারিই বিএনপি’র অনুসারি। সে সুবিধাভোগ করতে ভোল পাল্টিয়েছে। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।

জানতে চাইলে মুন্সি মনিরুজ্জামান মুকুল তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমাকে খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। আগে আমি একটি মতাদর্শের ছিলাম। সেখান থেকে তিন বছর আগে পদত্যাগ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামীলীগে যোগদান করি। আমার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।

খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবিদ হোসেন বলেন, একজন ব্যক্তি দল ত্যাগ করে অন্য দলে আসতেই পারেন। তিনি বিশেষ সুবিধা নিতে দলে অনুপ্রবেশ করেছেন কিনা সে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো। দলে যোগদানের পর তার অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি প্রসংগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুকুল ব্যবসা-বাণিজ্য করে, এ কারনে তার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটতেই পারে।

মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ মিজানুর রহমান মিজান গণমাধ্যমকে বলেন, দলে অনুপ্রবেশকারিদের কোন স্থান নেই। অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদেও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের দলে কোনো স্থান নেই। কেন্দ্রের নির্দেশে এ বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।

নগর আওয়ামীলীগের সভাপতি ও খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ত্যাগী ও দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ নেতা কর্মীদের মাঝে কোনো হাইব্রিড নেতা কর্মীকে স্থান দেয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যস্থা গ্রহণ করা হবে।

কেন্দ্রিয় আওয়ামীলীগ নেতা এসএম কামাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, সুবিধা লাভের আশায় কেউ আওয়ামীলীগে যোগদান করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।