1

খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে নতুন ভাবনায় বিএনপি

চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যু নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে বিএনপি। সর্বশেষ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন সরাসরি নাকচ হয়ে যাওয়ায় দলটির নেতারা হতাশ হয়েছেন।

আইনি প্রক্রিয়ায় তার মুক্তি অসম্ভব মনে করে নতুন উপায় বিশেষ করে অসুস্থ বিবেচনায় তার প্যারোলে মুক্তি চাওয়া হবে কিনা তা নিয়ে বিএনপিতে আলোচনা চলছে।

পাশাপাশি ভিন্ন চিন্তাও করছেন নেতারা। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করার কথাও ভাবা হচ্ছে। একইসঙ্গে বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে মুক্তির বিষয়ে দেনদরবার করতে হবে। আলোচনার পথ খোলা রেখে সরকারকে রাজি করাতে পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের সূত্র ধরে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি এপ্রিলে বেশ চাউর হয়েছিল। বিএনপি নেতারা তখন বলেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি চান না। বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান- দল, পরিবার ও সর্বোপরি খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণের বিষয়টি। অবশ্য শুরু থেকেই বিএনপির মধ্যম সারির নেতারা চেয়ে আসছেন- যে কোনো প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার কারামুক্তি।

এমন পরিস্থিতিতে আজ বিকালে গুলশান কার্যালয়ে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে আলোচনা করা হবে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জামিনের বিষয়টি আইনজীবীরা ভালো বলতে পারবেন। এরপরও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে খালেদা জিয়া ভিত্তিহীন মামলায় কারাগারে। এখন বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সবকিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তা না হলে জামিনযোগ্য মামলায় তার জামিন হচ্ছে না কেন? এটি রাজনৈতিক মামলা হওয়ায় সিদ্ধান্তও রাজনৈতিক হচ্ছে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রাজনৈতিক কারণে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাই সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া তার জামিন হবে না। আমি আগেও গণমাধ্যমে বলেছি, খালেদ জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। তার জীবন রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তাই জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে হলেও তাকে মুক্ত করা উচিত।

তিনি আরও বলেন, জানি না কার পরামর্শে তিনি (খালেদা জিয়া) প্যারোলে মুক্তি নিতে চাচ্ছেন না। প্যারোল একটি আইনগত সিদ্ধান্ত; এখানে কারও করুণার প্রশ্ন নেই। প্যারোল সরকারের দয়ার বিষয় নয়, এটা সাংবিধানিক অধিকার। তার চিকিৎসার জন্য দলের শীর্ষ নেতাদের এ মুহূর্তে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। না হলে একটি ভয়াবহ পরিণতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে জামিন ইস্যুতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। সেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্কাইপিতে যুক্ত ছিলেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন হাইকোর্টে সরাসরি খারিজ হয়ে যাওয়ায় তার মুক্তির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা মনে করছেন।

এখন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালাস চেয়ে যে আপিল আবেদন শুনানির অপেক্ষায় আছে, সেই আবেদনটি হাইকোর্টের অন্য কোনো বেঞ্চে উপস্থাপন করে জামিন আবেদন করা যেতে পারে। আর দ্বিতীয় প্রক্রিয়া হল হাইকোর্টের জামিন আবেদন খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়া। আইজীবীরা জানান, যেহেতু খালেদা জিয়ার কোনো আইনজীবীকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হচ্ছে না, সেহেতু এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবীরা সম্মিলিতভাবে আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেবেন।

গ্রেফতারের ১৭ মাস পেরিয়ে গেলেও আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি হতে পারে- এমন আশা এতদিন দলের অভ্যন্তরে কিছুটা হলেও ছিল। কিন্তু সর্বশেষ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন আবেদন সরাসরি নাকচ হয়ে যাওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিনিয়র নেতারা রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে চাপে পড়েছেন। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর সিনিয়র নেতারা তার মুক্তির জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেননি।

তারা বলেন, এখন বিএনপির একটিই দাবি- তা হল খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা। এ জন্য রাজপথে সব ধরনের কর্মসূচি পালন করতে হবে। ঢাকা মহানগরকে জেগে উঠতে হবে। কর্মসূচি সফল করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতার হওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। খালেদা জিয়ার মতো আপসহীন থাকতে হবে। তা হলেই খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব। অনেকের ধারণা ছিল- একাদশ সংসদে নির্বাচিতরা সংসদে যোগ দিলে সরকার নমনীয় হবে এবং খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেবে।

২৫ জুলাই খুলনার বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে আমরা তার সঙ্গে সংলাপ করেছি, নির্বাচনে গেছি। শপথ নিয়ে সংসদেও গেছি। কিন্তু সব পরীক্ষার ফল শূন্য। আমরা এখনও যদি মনে করি আমাদের নেত্রীকে সরকার মুক্তি দেবে তাহলে সেটি হবে ভুল। দীর্ঘদিন ধরে ‘গণতন্ত্রের মা’ ভিত্তিহীন মামলায় কারাবন্দি। কিন্তু তার জন্য আমরা কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে না পারলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। আমাদের দ্রুত আন্দোলন করতেই হবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, মূলত একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছেন। দলের চেয়ারপারসন কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে। বর্তমানে হরতাল, অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়ার চিন্তা তাদের মাথায়ও নেই। জনগণের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করেই আন্দোলনে নামবেন। সরকার চাপে না পড়লে খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো সম্ভাবনাই তিনি দেখছেন না বলেও জানান।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সময় বিদেশ সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৮ সালে বন্যায়ও রিকশা-নৌকায় করে মানুষের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন। আজকে তার অনুপস্থিতি দেশের মানুষ অনুভব করছে। আমরা শিগগিরই তাকে মুক্তির জন্য কঠোর কর্মসূচি দেব।

সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়। তাই আমরা বড় ধরনের কর্মসূচি চাই। আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক খোন্দকার মাশুকুর রহমান বলেন, আমরা মায়ের মুক্তির জন্য আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। তৃণমূল নেতারা মনে করেন আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না।