1

খালেদা জিয়ার মুক্তির আশায় তৎপর বিএনপি

শিগগিরই খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন- এই আশা জোরালো হয়েছে বিএনপিতে। দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসনকে মুক্ত করার লক্ষ্যে চলছে নানামুখী তৎপরতাও। পর্দার আড়ালে সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়েও চলছে জোর লবিং। একই সঙ্গে আইনি লড়াই জোরদার করতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন আইনজীবী ও দলীয় নেতারা। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে রাজপথে কর্মসূচি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে তারা। প্রাথমিক পর্যায়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী ২০ জুলাই চট্টগ্রাম এবং ২৫ জুলাই খুলনায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে কোণঠাসা বিএনপি।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্র দাবি করছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইনি লড়াই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাবসহ সার্বিক প্রেক্ষাপট খালেদা জিয়ার মুক্তির অনুকূলে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির নতুন কোনো মেরুকরণ না হলে বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির পথে বড় কোনো বাধা নেই। ঈদুল আজহার আগেই অর্থাৎ এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে তিনি মুক্তি পাবেন বলে আশা করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতা ও আইনজীবীরা। বর্তমানে মামলার বেঞ্চ পরিবর্তন করায় এ বিষয়ে কিছুটা কালবিলম্ব হচ্ছে বলে জানান তারা।

দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ১৭ বছরের জেল হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ৩৬ মামলার ৩৪টিতেই জামিনে রয়েছেন তিনি। সাজাপ্রাপ্ত এই দুটি মামলায় জামিন পেলেই মুক্তি পেতে পারেন তিনি।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে আবেদন দাখিল করা হয়েছে। সম্প্রতি নিম্ন আদালত থেকে ওই মামলার নথিপত্র হাইকোর্টের সংশ্নিষ্ট বেঞ্চে দাখিল করা হয়। এখন যে কোনো সময় শুনানি করতে পারেন আদালত। কিন্তু খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যে বেঞ্চে শুনানির জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন, সে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক ছুটিতে রয়েছেন। এ অবস্থায় অন্য একটি বেঞ্চে শুনানির ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তার আইনজীবীরা। অবশ্য এ নিয়ে দলীয় নেতা ও আইনজীবীদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে।

এদিকে গত ৩ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রয়েছেন খালেদা জিয়া। সেখান থেকে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ডায়াবেটিসের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তাকে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। আপাতত তাকে কেরানীগঞ্জের কারাগারে নাও নেওয়া হতে পারে বলে দাবি করছে বিএনপির একটি সূত্র।

সূত্রের মতে, খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেলেও তার রাজনৈতিক তৎপরতা শুরুর বিষয়টি নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করছে সরকারের উচ্চমহল। তবে আপাতত খালেদা জিয়ার মুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েই সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে গোপনে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেও পরে সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়টিও খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে চলমান তৎপরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দল, জোট ও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনা না করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এমপিদের সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পেছনে তার অসুস্থ মায়ের মুক্তির বিষয়টি কাজ করেছে বলে ওই সূত্র দাবি করেছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার মুক্তিই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে আইনগত লড়াই ও রাজপথের আন্দোলনসহ যা কিছু করা প্রয়োজন- তার সবই করবেন তারা।

সম্প্রতি ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার বিষয়ক একটি প্রতিনিধি দল আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এটা কি হস্তক্ষেপ নয়- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ইইউর মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি দলের প্রধান অ্যামন গিলমোর বলেন, বিষয়টি হস্তক্ষেপের নয়, উদ্বেগের। তারা সেটিই জানাতে এসেছিলেন। তবে বাংলাদেশের আইন এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। ইইউ খালেদা জিয়ার বিষয় পর্যবেক্ষণ করছে। পরে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বিচারিক ও উচ্চ আদালতের দেওয়া সাজার কারণে তিনি কারাগারে আছেন। এখানে সরকারের কিছু করার নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করবে না সরকার। কিন্তু যে দুটি মামলায় তার সাজা হয়েছে, সেগুলো ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবুল আলম বলেছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তারা মামলার জামিন আবেদন শুনানিতে বিরোধিতা করবে কি করবে না, সেটার সিদ্ধান্ত তাদের। তবে দুদকের আইনজীবী খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী জামিনের বিরোধিতা করবেন তারা। জামিন দেবে কি দেবে না- সেটা আদালতের বিষয়।

সরকারের সঙ্গে দেনদরবার :  নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করতে সরকারের উচ্চমহলের সঙ্গে বিএনপির দেনদরবার চলছে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে বিএনপির দু’জন শীর্ষ নেতার কয়েক দফা গোপন বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহের প্রথম দিকেও একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে খালেদা জিয়ার বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনা করে উন্নত চিকিৎসার লক্ষ্যে দ্রুত জামিনে মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়। প্যারোল নয়, জামিনেই মুক্তি পেতে খালেদা জিয়ার অনড় মনোভাবের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন বিএনপি নেতারা। অন্যদিকে বৈঠকের বিষয়বস্তু সরকারের শীর্ষ মহলকে অবহিত করার কথা জানান ওই প্রতিনিধি।

সূত্র আরও জানায়, ইতিপূর্বে গোপন বৈঠকে আলোচনার আলোকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রাজি হন খালেদা জিয়া।

আন্তর্জাতিক সমর্থনে লবিং : খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি। দলের আন্তর্জাতিক উইংয়ের নেতারা প্রভাবশালী দেশগুলোতে সফর করে এ তৎপরতা চালাচ্ছেন।

দলের আন্তর্জাতিক উইং সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আইনগত ও রাজনৈতিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। সে সময় খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়ে উল্লেখ করে তার মুক্তির ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ তৈরির অনুরোধ করেন ওই বিএনপি নেতা।

সূত্র আরও জানায়, গত সপ্তাহে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান তার গুলশানের বাসভবনে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় খালেদা জিয়ার মুক্তির পক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করেন তারা।

বিএনপির আন্তর্জাতিক উইংয়ের প্রধান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে কারাবন্দি করে রাখার বিষয়টি তারা সবার সামনে তুলে ধরছেন। ইতিমধ্যে অনেকেই খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

আন্তর্জাতিক উইংয়ের অপর সিনিয়র সদস্য ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার। তারা আশা করছেন, শিগগির তিনি মুক্তি পাবেন। এ লক্ষ্যেই কাজ করছেন তারা।

আইনি লড়াই জোরদার :  দলীয় সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আইনি লড়াই চালানো নিয়ে দলের সিনিয়র ও জুনিয়র আইনজীবীদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে মামলা পরিচালনা নিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তারেক রহমানের পরামর্শে সিনিয়র নেতারা আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টির সমাধান করেন। এখন সমন্বয়ের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করছেন তারা। আইনি লড়াইয়ে যাতে কোনো ত্রুটি না হয়, তা পর্যালোচনা করতে দু-একদিন পরপরই শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আইনজীবীরা বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে স্কাইপের মাধ্যমে লন্ডন থেকে তারেক রহমানও যুক্ত হন।

এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার শীর্ষ আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সরকারের প্রতিবন্ধকতার কারণেই খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি বিলম্বিত হচ্ছে। তিনি আশা করেন, সরকারের দিক থেকে প্রবল আপত্তি না থাকলে আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পাবেন।