1

কালো টাকা সাদা করেও রেহাই নেই দুদকে

অর্থ অর্জনের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবে না- এই সুবিধা দিয়ে এবারের বাজেটে সুনির্দিষ্ট দুটি খাতে কালো টাকা সাদা করার (বিনিয়োগের) সুযোগ দেওয়া হয়েছে। উৎস গোপনের এই সুযোগ দেওয়া হলেও দেশের বিদ্যমান আইনের কারণে কালো টাকার মালিকদের শঙ্কা থেকেই গেছে। বিনিয়োগকৃত কালো টাকার উৎস জানা ও সেই টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হলে সংশ্নিষ্টের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে।

এতে বাজেটে কালো টাকার মালিকদের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেই সুযোগ শঙ্কামুক্ত নয়। আইন অনুযায়ী কালো টাকার মালিকদের জবাবদিহি করতেই হবে। একই সঙ্গে আইনের আওতায় আসতে হবে।

সূত্র জানায়, বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ ও আইন অনুযায়ী কালো টাকার মালিকদের আইনি প্রক্রিয়ায় আনার সুযোগ- এই দুটি এখন বিদ্যমান। দুটি সুযোগই একে অপরের পরিপন্থি।

দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অনেক সময় প্রদর্শিত আয়ের সঙ্গে দেখানো হয়নি- এমন টাকা পরবর্তী সময়ে বৈধ করা যাবে বলে নানা কথা বলা হয়ে থাকে। এটি একটি প্রচলিত কথা। কিন্তু সেই টাকা যদি চুরির টাকা হয়, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয় বা ওইসব টাকায় দুর্নীতির যদি কোনো সংশ্নেষ থাকে সেটাকে দুর্নীতি হিসেবেই দেখবে দুদক। একই সঙ্গে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আমার কথা হলো, টাকাটা যদি দুর্নীতির হয়- সেই টাকা দিয়ে মসজিদ বানালেও আমরা সেটা দেখব। টাকার ব্যবহার যাই হোক না কেন, সেটা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হলে আইনের আওতায় আসবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতিবান্ধব। এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির পরিপন্থি। কালো টাকা ব্যবহারের সুযোগপ্রাপ্ত খাতে দুর্নীতির একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সৎপথে এসব খাতে আয় ও সম্পদ আহরণের সুযোগ ধূলিসাৎ হবে ও এর প্রভাবে দুর্নীতির বিস্তৃতি ও গভীরতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

জানা গেছে, ফ্ল্যাট ও জমিতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে। এর আগের বাজেটে শুধু ফ্ল্যাটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। এবার জমিতেও বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিগত দিনে বাজেটে সরকারের পক্ষ থেকে এই সুযোগ দেওয়া হলেও সংশ্নিষ্ট বিনিয়োগকারীরা কখনও আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তারা আইনের আওতায়ই ছিলেন।

বিগত দিনে একদিকে সরকার ফ্ল্যাটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে, অন্যদিকে দুদককে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে সংশ্নিষ্টদের ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের অর্থের উৎস জানাতে হয়েছে। যারা এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বৈধ উৎস জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, চার্জশিট হয়েছে। বিগত দিনে অবৈধ অর্থে ফ্ল্যাট কেনার অভিযোগে বহুসংখ্যক মামলা হয়েছে।

প্রতি বছরের মতো এবারও বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন দল, সামাজিক-পেশাজীবী সংগঠনের নেতারাও কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধে দাবি জানিয়ে আসছে। কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতসব প্রতিবাদের পরও সরকার প্রতি বছরই বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে আসছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, সুশাসন ও ন্যায্যতার পরিপন্থি হলেও দফায় দফায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে এসেছে একের পর এক সরকার, যা সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সুনির্দিষ্ট লঙ্ঘন। এটি দুর্নীতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত নীতির পরিপন্থি হলেও এবারের বাজেটে এই অনিয়মকে বাদ না দিয়ে বরং এর পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে। ফ্ল্যাটের পাশাপাশি এবার জমি কেনাকেও যোগ করা হয়েছে।

সংশ্নিষ্টদের মতে, একদিকে সরকার কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুদকের আইনে কালো টাকার ওই বিনিয়োগকে দুর্নীতি হিসেবে আমলে নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটি দ্বান্দ্বিক ও সাংঘর্ষিক।

কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। এটি সংবিধান পরিপন্থি। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- ভবিষ্যতে এই সুযোগ রাখা হবে কি হবে না। গত ১৩ জুন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করে। বাজেট পাস হয় গত ৩০ জুন।

সূত্র জানায়, কোনো ব্যক্তির, তার স্ত্রী, তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের স্বনামে-বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ/সম্পত্তি, দায়দেনা, আয়ের উৎস্য ও ওইসব সম্পদ অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ চেয়ে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির ওপর নোটিশ জারি করা যায় দুদক আইন-২০০৪ এর ২৬(১) ধারায়। ওই নোটিশ প্রাপ্তির নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দুদক সচিব বরাবর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে আইনে। আইনের এই ধারায় নির্দিষ্ট কোনো খাতকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়নি, যে খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে ব্যর্থ হলে আইনের ২৬(২) ধারায় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে।