1

এরশাদের মৃত্যুতে দেশ-বিদেশে শোক, আজ নেওয়া হবে রংপুরে

এরশাদের জীবনাবসানে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, নেতা ও কূটনীতিকরা। জাতীয় পার্টি ৩ দিনের শোক ঘোষণা করেছে। এছাড়া এরশাদের নির্বাচনী এলাকা ও উত্তরাঞ্চলেও অসংখ্য মানুষকে শোক প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান জানান, সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে এরশাদ মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর ৬ মাস। আগামীকাল মঙ্গলবার ঢাকায় সামরিক কবরস্থানে তাঁর মরদেহ দাফন করা হবে বলে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

এইচ এম এরশাদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শোক প্রকাশ করেছেন।

গতকাল বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাস কেন্দ্রীয় মসজিদে এরশাদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আজ সোমবার সকাল ১০টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে সকাল ১১টায় মরদেহ নেওয়া হবে জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয়ে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বাদ আসর। এরপর মরদেহ রাখা হবে সিএমএইচের হিমঘরে। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় এরশাদের মরদেহ হেলিকপ্টারে রংপুর নেওয়া হবে। রংপুর শহরের জিলা স্কুল মাঠে চতুর্থ জানাজা শেষে মরদেহ ঢাকায় আনা হবে এবং বিকেলে সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। ১৭ জুলাই বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে এরশাদের কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে বলে পার্টির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সাবেক সেনাপ্রধান ও সেনাশাসক এরশাদের জীবনাবসান ঘোষণার খবর পাওয়ার পরপরই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ছুটে যান তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ, ছেলে সাদ এরশাদ, মেয়ে মেহজাবিন, পুত্রবধূ মিমি, ছোট ভাই জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ আত্মীয়স্বজন ও  জাতীয় পাটির কেন্দ্রীয় নেতারা। আগেই সিএমএইচে ছিলেন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব মেজর (অব.) খালেদ আকতার। ছোট ভাই  জি এম কাদের সিএমএইচে পৌঁছানোর পর পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। এরপর এরশাদপুত্র এরিখ এরশাদকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। ভারত ভ্রমণরত এরশাদের সাবেক স্ত্রী, এরিখের মা বিদিশা সিদ্দিক এরশাদের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে পরপারে দেখা হওয়ার বাসনা জানান।

গতকাল বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাস কেন্দ্রীয় মসজিদে এইচ এম এরশাদের প্রথম জানাজার সময় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়। এতে জানানো হয়, এরশাদকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে। এরশাদের প্রথম জানাজায় অংশগ্রহণ করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, বিমানবাহিনী প্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, ছেলে সাদ এরশাদ, রাজনৈতিক সচিব খালেদ আকতার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জানাজায় অংশ নেন।

জাতীয় পার্টির অন্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন রুহুল আমিন হাওলাদার, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়া উদ্দীন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, এস এম ফয়সাল চিশতি, সফিকুল ইসলাম সেন্টু, মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, মীর আবদুস সবুর আসুদ, আলমগীর শিকদার লোটন প্রমুখ। জানাজা-পূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের কান্নাজড়িত কণ্ঠে করজোড়ে বড় ভাইয়ের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

এরশাদকে রক্তের সংক্রমণজনিত জটিলতায় গত ২৬ জুন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ধীরে ধীরে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ৪ জুলাই বিকেল ৪টায় এরশাদকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।

দলের চেয়ারম্যান এরশাদকে সামরিক কবরস্থানে দাফনের বিরোধিতা করে গতকাল জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেছে পার্টির বেশ কিছু নেতাকর্মী। তারা দাবি তোলে, এরশাদকে এমন কোনো জায়গায় দাফন করা উচিত যেখানে সাধারণ মানুষ সহজে যেতে পারে। এরশাদের মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা বনানী কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকে। এ সময় অনেককে কাঁদতে দেখা যায়।

এরশাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশকারীদের মধ্যে রয়েছেন—ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রমুখ। আরো শোক প্রকাশ করেছেন—জাকের পার্টির চেয়ারম্যান পীরজাদা মোস্তফা আমীর ফয়সাল মুজাদ্দেদী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।

শোক জানালেন প্রণবসহ বিদেশিরা

কালের কণ্ঠ’র কূটনৈতিক প্রতিবেদক জানান, এরশাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, নেতা ও কূটনীতিকরা। প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর টুইট বার্তায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, রাষ্ট্রপতি এবং পরে খ্যাতনামা বিরোধী নেতা হিসেবে বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসে জেনারেল এইচ এম এরশাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্মরণ করেন। তিনি লিখেছেন, ‘সার্ক সৃষ্টির পেছনে এরশাদের ভূমিকা দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতায় নতুন অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর এরশাদকে নিয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে টুইট বার্তা লিখেছেন। গভীর শোক প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে বিশেষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে তাঁর (এরশাদ) অবদান ও বাংলাদেশে জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’

ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের সাবেক ছাত্র ড. তান্দি দরজিও টুইট বার্তায় এরশাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারসন ডিকসন টুইট বার্তায় এরশাদের চিরশান্তি কামনা করেন। ঢাকায় কানাডার হাইকমিশনার বেনোয়া প্রিফন্টেইন টুইট বার্তায় প্রয়াত এরশাদের শোকসন্তপ্ত পরিবার ও প্রিয়জনদের সমবেদনা জানান এবং এরশাদের শান্তি কামনা করেন।

এরশাদের কথা স্মরণ করেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনিল ত্রিগুনায়াত। টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় এরশাদের সঙ্গে বেশ কবার তাঁর দেখা করার সুযোগ হয়েছে। সম্পর্কে ভারসাম্য রাখার পাশাপাশি এরশাদ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন।’

জাতীয় পার্টির ৩ দিনের শোক

চেয়ারম্যানের মৃত্যুতে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি। গতকাল বিকেলে পার্টির বনানী কার্যালয়ের সামনে এ ঘোষণা দেন পার্টির মহাসচিব মো. মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বলেন, শোক পালনকালে জাপার সবাই কালো ব্যাজ ধারণ করবে এবং জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।’ পার্টির চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক সচিব সুনীল শুভ রায় জানিয়েছেন, ১৫ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত পার্টির বনানী ও কাকরাইল কার্যালয়ে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শোকবই খোলা থাকবে।

এরশাদ গত বছর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। এ কারণে দলের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারেননি তিনি। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে সর্বশেষ গত ২৬ জুন সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। এর আগে জানুয়ারিতে রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতিজনিত কারণে তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা নেন। তাঁর লিভারেও সমস্যা ছিল। তবে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসায় এরশাদের শারীরিক অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। অসুস্থ অবস্থায় হুইলচেয়ারে করে জাতীয় সংসদে গিয়ে রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন তিনি। রোজার সময় ট্রাস্ট গঠন করে এরশাদ তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ওই ট্রাস্টে দান করেন। একই সঙ্গে জাতীয় পার্টিতে তাঁর উত্তরসূরি মনোনীত করেন ছোট ভাই সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদেরকে। তাঁকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এরশাদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের রংপুর জেলার দিনহাটায়। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬০-৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থিত স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯-৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় এরশাদ ছুটিতে রংপুরে ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে বাঙালি এই সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তান চলে যান। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া বাঙালিদের সঙ্গে তিনিও দেশে ফিরে আসেন। পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর ১৯৭৩ সালে তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই বছর ১২ ডিসেম্বর তিনি কর্নেল এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি পান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ভারতে প্রশিক্ষণরত এরশাদ বাংলাদেশের দিল্লি মিশনের মাধ্যমে দেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে বার্তা পাঠান। ওই বছর ২৪ আগস্ট ভারতের আগ্রায় প্রশিক্ষণরত অবস্থায় তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি এবং উপসেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনী প্রধানের পদে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।