1

ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড ফাইনাল আজ

টাওয়ার অব লন্ডনে যে ভ্রমাত্মক তথ্য আজও থেকে গেছে, তা হলো মহারানী ভিক্টোরিয়াকে কোহিনুর উপহার দিয়েছিলেন পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং। যা নিয়ে ভারতীয়রা এখনও বলে থাকে- ওটা উপহার নয়, ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কোহিনুর নিয়ে ঐতিহাসিক অস্বচ্ছতা থাকলেও আজ লর্ডসে ‘ক্রিকেটের কোহিনুর’ মাথায় তুলতে কোনো বিতর্ক চায় না ইংল্যান্ড। বিশ্বক্রিকেটের আদিবাড়ি লর্ডস থেকে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েই সেই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করে নিতে চান ইয়ন মরগানরা। নিজেদের উঠানে ঘরভর্তি মানুষের সামনে লড়াই করেই অধরা বিশ্বকাপ ট্রফি স্পর্শ করতে চায় ইংলিশরা। লর্ডসও বুঝি সেটাই চায়, ব্রিটিশ সিংহরাই তার বারান্দায় ট্রফি নিয়ে শ্যাম্পেইনের ছিপি খুলুক, উল্লাসে মেতে উঠুক টেমসপাড়ে। লন্ডনের এই হৃদয়ঘণ্টা কিউইরাও শুনতে পেয়েছে। কিন্তু তারাই বা ছেড়ে কথা বলবে কেন, বিশ্বকাপ ট্রফি যে তাদেরও অস্পর্শ থেকে গেছে। রাজবাড়িতে তাই আজ রাজকীয় এক ফাইনালই হচ্ছে। যুদ্ধের শঙ্খনাদ বেজেছে ঐতিহাসিক লর্ডসে। অপেক্ষা শুধু নতুন চ্যাম্পিয়নকে বরণ করে নেওয়ার।

ইংল্যান্ড ফাইনালে ওঠার পর থেকেই ব্রিটিশ মিডিয়ায় একটি লেখালেখি চলছে খুব, তা হলো- ক্রিকেট রিটার্ন হোম…। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ও এ স্লোগান দিয়েছিল তারা। কিন্তু ফুটবল ঘরে না ফিরলেও ক্রিকেট নাকি ঠিকই ফিরবে তার জন্মভিটায়। গেল আটচল্লিশ ঘণ্টায় এই বিশ্বাসটা মরগানদের মধ্যেও গেঁথে গেছে। ‘ঘরের মাঠে, প্রিয় মানুষের সামনে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে নামব আমরা। বিশ্বকাপ জয়ের এ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না ড্রেসিংরুমের কেউ। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড আগেও খেলেছে, তখন অনেক ছোট ছিলাম। তাই বুঝিনি, এখন বুঝি ইতিহাসের এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে লর্ডসে বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলার সুযোগ কতটা গর্বের।’ গতকাল হলরুমভর্তি সাংবাদিকদের ভিড়ে মরগানের এই বক্তব্যটুকু নাড়িয়ে দিয়েছিল সবাইকে।

নিজে আয়ারল্যান্ডের ছেলে, এখন অবশ্য ইংল্যান্ডেই থাকেন। তার মতো এবারের ইংলিশ দলে অন্তত ছয়জন রয়েছেন, যারা কেউ পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত, কেউ নিউজিল্যান্ডের, কেউ দক্ষিণ আফ্রিকার এবং কেউ আবার বার্বাডোজের। কিন্তু আজ তারা সবাই খাঁটি ব্রিটিশ! আজকের ফাইনাল নিয়ে ইংল্যান্ড দল অনেক বেশি আবেগী। প্রেসবক্সের বয়স্ক এক রেডিও সাংবাদিক বলছিলেন, এই আবেগটাই না আবার সবকিছু শেষ করে দেয়। ১৯৯২ বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে পাকিস্তানের ইমরান খানের সামনে এই আবগে ভরা ইংলিশ দলই হেরেছিল। এবার তো আবার আবেগের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রত্যাশার চাপ। লন্ডনের বৈধ ব্যাটিং সাইট ল্যাডব্রোকসের আজকের ফাইনালে ইংল্যান্ডই ফেভারিট। রেট ৮৭/১৩!

এ তো গেল আবেগ আর বাজারের ব্যাপার। মাঠের শক্তিতে কে এগিয়ে আজ?

বোলিং :পেস অ্যাটাকে দু’দলই সমানে সমান। কিউইদের হাতে আছে ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরি আর লুক ফার্গুসন ত্রয়ী। গতির চেয়েও তাদের সুইং বেশি ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে নতুন বলে ইংল্যান্ডের আতঙ্ক হতে পারেন এদের কেউ। তুলনায় ইংল্যান্ডেরও আছেন ক্রিস ওকস, জোফার আর্চার আর মার্ক উড। সুইংয়ের চেয়েও এদের গতি কিউইদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষ করে আর্চার। যিনি প্রথম বল থেকেই ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতি ছোটাতে পারেন। তবে স্পিনে নিউজিল্যান্ডের চেয়ে খানিকটা এগিয়ে ইংল্যান্ড। একে তো নিজেদের মাঠ, চেনা পরিবেশ। তার ওপর আদিল রশিদের গুগলি। সেই তুলনায় কিউই স্পিনার স্যান্টনার কিছুটা পিছিয়ে।

ব্যাটিং :নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ড এগিয়ে। জেসন রয়, বেয়ারস্টো, জো রুট, ইয়ান মরগান- প্রত্যেকেই ফর্মে রয়েছেন। তা ছাড়া এই বিশ্বকাপেই তারা সাড়ে তিনশ’র কাছাকাছি বেশ কিছু ইনিংস খেলেছে। এমনকি চারশ’ রান করার মতো ব্যাটসম্যানও নাকি তাদের মজুদ আছে। সেই তুলনায় নিউজিল্যান্ডের দুই ওপেনার গাপটিল আর নিকোলস সেভাবে ফর্মে নেই। তিন নম্বরে নামা কেন উইলিয়ামসন একাই যা ইনিংস টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান টেলরও নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না।

অলরাউন্ডার :নিউজিল্যান্ডের লোয়ার অর্ডারে নিশাম আর গ্র্যান্ডহোমের মতো কিছু হার্ডহিটার রয়েছে। যারা যে কোনো মুহূর্তে ম্যাচের রঙ বদলে দিতে পারেন। ইংল্যান্ডেরও হাতে আছে বেন স্টোকস আর ওকসের মতো কিছু হার্ডহিটার। তবে অলরাউন্ডার তুলনায় কিউইরা খানিকটা এগিয়ে।

এভাবে দু’দলের শক্তি দুর্বলতায় খুব বেশি পার্থক্য ধরা না পড়লেও বিশ্বকাপের ফাইনালে স্নায়ুর শক্তি বড় একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেখানে কিন্তু ইংলিশদের চেয়ে কিউইরা খানিকটা এগিয়ে। গতবারই তারা বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে। সেই দলের অনেকেই আজ লর্ডসে নামবেন। তুলনায় মরগানের এই ইংলিশ দলটির জন্য এটাই বড় কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ। গ্রুপ পর্বে অবশ্য এই ইংল্যান্ডের কাছে ১১৯ রানের বিশাল ব্যবধানে লজ্জার হার হারতে হয়েছিল কিউইদের। বেয়ারস্টোর সেঞ্চুরি দিয়ে ৩০৫ করেছিল ইংল্যান্ড, তাড়া করতে নেমে নিউজিল্যান্ড ১৮৬ রানে অলআউট! তবে আজকের ম্যাচটিতে বড় স্কোর হওয়ার কোনো ইঙ্গিত দিতে পারছেন না কেউ। লর্ডসের কিউরেটদের মুখে এমনিতেই কলুপ, তবে দূর থেকে পিচে সবুজ ঘাসের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আর যা-ই হোক, ব্যাটিং সহায়ক উইকেট এটি নয়। এমনিতেই দুই দলের হাতে পেস চার্জার, তার মধ্যে আবার লেলিয়ে দেওয়া ঘাস। প্রেসবক্সের ব্রিটিশ সাংবাদিকরা মজা করে বলছিলেন, বাইশ গজে কাল আগুন না ধরে যায়। পিচ রিপোর্ট যা-ই বলুক না কেন, আবহাওয়া রিপোর্ট কিন্তু আজ বেশ সাদাসিধে। নাহ, বৃষ্টির কোনো ভয় নেই। তবে কিছু সময় মেঘলা থাকবে, বাতাস আসবে একদিক থেকে।

সারাদিন যা-ই হোক, লর্ডসের কাছে শুধু বিকেলটুকু চেয়ে রাখছে ইংল্যান্ড। গোধূলি আলোতে ওই সোনালি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা তখন শুধু ক্রিকেটের কোহিনুরটা তুলে ধরতে চায়। দশকের পর দশক তাদের এই লালিত ইচ্ছেটা আজ পূরণ হবে কি? অপেক্ষা আর কয়েক ঘণ্টার।