1

আসছে রাঘববোয়ালদের নাম

পুলিশের জেরার মুখে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছে রাঘববোয়ালদের নাম। একে একে যখন নাম বলছিলেন তিনি, পুলিশ তা শুনে হতবাক হচ্ছিল। দীর্ঘ তালিকায় রয়েছে পুলিশ, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মিডিয়া জগতের কতিপয় ব্যক্তিত্বের নাম। খালেদ বলেছেন, এদের নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েই তিনি ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, খালেদ অনেক অজানা তথ্যই ফাঁস করেছেন। ক্যাসিনো ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার হাতে। তবে এখানকার টাকার ভাগ পেত পুলিশের সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, ডিসি, রাজনৈতিক নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি ক্যাসিনো থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হতো। লাভের অংশের ভাগ সবার কাছে পৌঁছে দিতে হতো। থানার ওসির কাছে মাসিক হারে কয়েক লাখ টাকা দিতে হতো। সংশ্লিষ্ট জোনের পুলিশের সহকারী কমিশনার ও উপকমিশনারের কাছেও মাসিক হারে টাকা পৌঁছে যেত, এমনকি যারা উপপরিদর্শক বা পরিদর্শক লেভেলের, তাদেরও টাকা দিতে হতো। তবে তাদের পরিমাণটা ছিল কম। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ক্যাসিনো এলাকার পুলিশের বিট অফিসারও পেতেন টাকার ভাগ। তিনি জানান, টাকার ভাগ রাজনৈতিক নেতার পকেটেও যেত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো। কাউকে কাউকে গাড়ি উপহার দিতে হয়েছে। অনেককে দিতে হয়েছে দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকা দামের মোবাইল ফোন। এমন নেতাদের তালিকাও হয়েছে। এরই মধ্যে খালেদ সবার তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দিয়েছেন।

সূত্রটি জানায়, ক্যাসিনোর টাকার ভাগ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও চলে যেত। যেসব সন্ত্রাসী দেশের বাইরে থাকে, তারাই মূলত এই ভাগ পেত। খালেদ জানিয়েছেন, মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির সন্ত্রাসী নাজির আরমান নাদিম ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের হয়ে ঢাকায় কাজ করেন খালেদ। চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনোর টাকা ওমানের মাসকটে থাকা সন্ত্রাসী নাদিমের কাছে পাঠান খালেদ। সেখান থেকে জিসানও ভাগ পান টাকার। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান বর্তমানে ভারতের পাসপোর্ট দিয়ে দুবাইয়ে স্থায়ী হয়েছেন। জিসানের দুবাইয়ে চারটি গোল্ডের দোকান আর আল ফাজিরা সিটি জায়েদ শেখ মার্কেটে রয়েছে নাইট ক্লাব। এসব ব্যবসায় চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ীর শেয়ার রয়েছে। ওই সুবাদে জিসান জার্মানি থেকে দুবাইয়ে আসা-যাওয়া করেন। ঢাকায় তার যেখানে যেখানে আধিপত্য ছিল, এর সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেদ। খালেদ জানিয়েছেন, গভীর রাতে ক্লাবগুলোয় আসতে শুরু করে বিত্তবানদের গাড়ি। তাদের সঙ্গে থাকে ঢাকাই সিনেমার উঠতি নায়িকা থেকে শুরু করে নামিদামি মডেল। এসব মডেল-অভিনেত্রী জুয়ার আস্তানায় ‘এস্কর্ট গার্ল’ হিসেবে পরিচিত। জানা গেছে, এ ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন কেন্দ্রীয় ও মহানগরী উত্তর-দক্ষিণ যুবলীগের একশ্রেণির নেতা। অবৈধভাবে চালানো এসব জুয়ার আসরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ছয় নেতা মাঝেমধ্যে অংশগ্রহণ করেন। ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ চারটি দেশ থেকে প্রশিক্ষিত নারীদের আনা হয়। প্রশিক্ষিত জুয়াড়ির পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রহরীও আনা হয়েছে নেপাল থেকে। ক্যাসিনোগুলোয় প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা উড়ছে।
সূত্র জানায়, রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুলে কমপক্ষে ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন এই যুবলীগ নেতা। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাব নিজের লোকজন দিয়ে আর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স নামের ক্লাবটি সরাসরি তিনি পরিচালনা করেন। প্রতিটি ক্লাব থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১ লাখ টাকা নেন তিনি। এসব ক্লাবে সকাল ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যাসিনো বসে। খিলগাঁও-শাহজাহানপুর হয়ে চলাচলকারী লেগুনা ও গণপরিবহন থেকে নিয়মিত টাকা দিতে হয় খালেদকে। প্রতি কোরবানির ঈদে শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া ও কমলাপুর পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে প্রতিদিন রাতে মাছের একটি হাট বসান এই নেতা। সেখান থেকে মাসে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা আদায় করেন তিনি। একইভাবে খিলগাঁও কাঁচাবাজারের সভাপতির পদটিও দীর্ঘদিন তিনি ধরে রেখেছেন। শাহজাহানপুর রেলওয়ের জমি দখল করে দোকান ও ক্লাব নির্মাণ করেছেন।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মুগদার পুরো নিয়ন্ত্রণ এই নেতার হাতে। এসব এলাকায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথাক্রমে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক, রেলভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুবভবন, কৃষিভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ বেশির ভাগ সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন এই নেতা। ‘ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া’ নামের প্রতিষ্ঠানটি দিয়ে তিনি তার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সূত্র জানায়, একসময়ের দাপুটে ছাত্রনেতা মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল শাহরিয়ারকে ভয় দেখিয়ে দেশছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সোহেল শাহরিয়ার বর্তমানে কানাডায় বসবাস করেন। একইভাবে ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি আলী হোসেন ও ১২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি কবির মাহমুদকেও ভয় দেখিয়ে শহরছাড়া করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এলাকাবাসী জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন-ডিএসসিসির নির্বাচনে কাউন্সিলর হতে ব্যাপক কার্যক্রম চালান খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে মমিনুল হক সাঈদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এরপর তার সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।