1

আশ্রয় ও ত্রাণের খোঁজে বন্যার্তরা

বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পদ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন বন্যার্তরা। অনেকেই পরিবারসহ ডিঙি নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ছোট ছোট নৌকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে চলছে অনেকের।

উত্তরাঞ্চলে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বাড়ছে মধ্যাঞ্চলে। অনেক এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বন্যার্তরা ছুটছেন ত্রাণের আশায়। এদিকে বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়েছে। তবে অনেক স্থানে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সেভাবে ত্রাণ পৌঁছেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কৈতকিরহাট গ্রামের ওরচিনা বেগম (৫৬) জানান, পানি বাড়িঘরে ওঠায় পাঁচ দিন আগে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন স্বামী, চার ছেলে-মেয়ে, দুই ছেলের বউ ও নাতিপুতি নিয়ে। ত্রাণ তো দূরের কথা আজ পর্যন্ত কেউ তাদের খোঁজ নিতে আসেনি।

ওরচিনার স্বামী ইয়াদ আলী কৃষিকাজ করেন। কাজ না থাকায় বসে থাকা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। একই অবস্থা আশ্রিত নিরু মিয়ারও। এই বাঁধে আশ্রয় নেওয়া শত শত পরিবারের একই অবস্থা। দু-একজন ছাড়া সবাই বলছেন তারা কোনো ত্রাণ পাননি।

সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য বলে জানিয়েছেন দুর্গত এলাকার মানুষ। এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, দেশে বন্যা দীর্ঘমেয়াদি হলেও দুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রীর কোনো অভাব হবে না।

পানিসম্পদ উপমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একযোগে বন্যায় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুসারে সারাদেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ দলের সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ইতিমধ্যে সারাদেশে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

এদিকে শনিবার জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনির উদ্যোগে ও পৌর আওয়ামী লীগের সহায়তায় গাইবান্ধা শহরে বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা হিসেবে রুটি বিতরণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। যতদিন বন্যার পানি থাকবে, ততদিন এ কর্মসূচি চলবে। এজন্য জেলা পাবলিক লাইব্রেরিতে রুটি তৈরি করার জন্য স্বেচ্ছাশ্রম হিসেবে আওয়ামী লীগের নারীকর্মীসহ সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছেন। এছাড়া গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণের খবর এসেছে।

এদিকে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শনিবারও প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। মানিকগঞ্জে যমুনা নদীর পানি আরিচা পয়েন্টে বিপদসীমার ৮২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে মানিকগঞ্জের পাঁচ উপজেলার ৩০ ইউনিয়নের ৭০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানি সরাতে এলেঙ্গা-ভুঞাপুর সড়ক কেটে দিয়েছে স্থানীয় লোকজন। এতে শনিবার দুপুর থেকে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলে যমুনা ও ধলেশ্বরীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ধসে যাওয়া সড়ক মেরামতের কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

রাজবাড়ীতে পদ্মার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জামালপুরের ৭ উপজেলার পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলা সদরের সঙ্গে যমুনা সেতুর পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত ট্রেন চলাচল এবং তারাকান্দি, ভুঞাপুর, সরিষাবাড়ী ও দেওয়ানগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সড়কে পানি ওঠায় শেরপুর-জামালপুর সড়ক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে আছে।

ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে নতুন করে ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি সামান্য কমেছে। সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারার পানি কমতে শুরু করেছে। পানি কমায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ভেসে উঠছে। মৌলভীবাজারে ধলই ও মনু নদীর পানিও কমছে। নেত্রকোনায় সোমেশ্বরী, উব্ধাখালি, ধনুসহ নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে।

এ দিকে বন্যার কারণে ঢাকাসহ সারাদেশে শাকসবজি থেকে শুরু করে সকল পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছেন কাঁচাবাজার ব্যবসায়ীরা।

বন্যার পানি বৃদ্ধি ও স্রোতের কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে যানবাহন পারাপারে অচলবস্থা চলছে। দু’দিন ধরে নৌ চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। শনিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, তাদের ৯৩টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে ৩৯টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ৫২টি পয়েন্টে পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। ২১টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। অপরিবর্তিত আছে দুটিতে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকায় আগামী ২৪ ঘণ্টা পানি বাড়বে। এতে পদ্মার পানি সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী বগুড়া, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে পরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে। টাঙ্গাইল এবং সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জে অবনতি ঘটবে। ঢাকার চারপাশের নদী তীরবর্তী নিচু এলাকা প্লাবিত হতে পারে।